বৃহস্পতিবার ৬ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি ৩১শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সাদাকাতুল-ফিতর ও যাকাতের আহকাম

রোযাদার যেন তার রোযাকে বেহুদা ও অশ্লীল কথা বার্তা ও গর্হিত আচরণ থেকে পবিত্র করতে পারেন এবং ঈদের আনন্দে ধনীদের সাথে গরীবদুখীরাও যেন শরীক হতে পারেএ মহান দুইটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সাদাকাতুলফিতর ওয়াজীব করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদাকাতুলফিতরকে ওয়াজিব করেছেনরোযাকে বেহুদা ও অশ্লীল কথাবার্তা জনিত অপরাধ থেকে ও গর্হিত আচরণ থেকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে এবং মিসকিনদের খাদ্যের সুব্যবস্থার জন্যে। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করবে, তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের পরে তা আদায় করবে, তার জন্য তা একটি সাধারণ দান হিসাবে গণ্য হবে ।

আবু দাউদ শরীফ ।

সাদাকাতুলফিতর মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা রমযানুল মুবারকের শেষে ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করতে হয়। মুসলিম উম্মাহ এ আমলটিকে নববী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক আমলের সাথে নিয়মিত আমল করে আসছে।ইহা আমাদের অঞ্চলে ফিতরানামে পরিচিত। সাদাকাতুলফিতর ও যাকাত কেবল তাদেরই আদায় করতে হবে যারা নিসাব পরিমাণে মালের মালিক। নিম্নে নিসাবের আলোচনা তুলে ধরা হল।

 

নিসাব

…………..

কি পরিমাণ মাল হলে যাকাত দিতে হবে তা মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, আর এর নির্ধারিত পরিমাণকেই নিসাববলে।

সোনার নিসাব হচ্ছে, বিশ মিছকাল ( সাড়ে সাত তোলা)। রুপার নিসাব হচ্ছে,দুশ দিরহাম (সাড়ে বায়ান্ন তোলা)

অর্থাৎ,সাড়ে সাত তোলা সোনা ও সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমমূল্যের নগদ টাকা হচ্ছে নিসাব। এই নিসাব পরিমাণ সোনা বা রূপা অথবা সমমূল্যের নগদ টাকা, যে ব্যক্তির কাছে থাকবে তাকে সাহেবে নিসাব বা নিসাবের মালিক বলা হবে।এই সাহেবে নিসাবের উপর যাকাত দেওয়া ফরজ করা হয়েছে।তিনি উক্ত সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত হিসাবে আল্লাহর নির্দেশিত পথে অবশ্যই খরচ করবেন।

 

কাদের উপর যাকাত ও সদকাতুলফিতর ওয়াজিব?

……………………………..

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ হচ্ছেস্বাধীন হওয়া, মুসলমান হওয়া, বালেগ তথা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া, আকেল বা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, নিসাব গ্রাস করে নেয় এমন পরিমাণ ঋণ থেকে মুক্ত থাকা, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া এবং উহার উপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া এবং ব্যবসায়ের মাল হওয়া।

ব্যবসার আসবাবপত্র ও অলংকারাদি যদি সোনা বা রূপার মূল্যের পরিমাণে হয় এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত হয় তাহলে এগুলোর উপরও যাকাত ফরজ।

যাকাতের নিসাব ও সদাকাতুলফিতরের নিসাব একই রকমের, তবে শুধু এতটুকু পার্থক্য যে যাকাতের নিসাবের উপর বছর অতিবাহিত হতে হয়,এবং ব্যবসার মাল হতে হয়; কিন্তু সাদাকাতুলফিতরের ক্ষেত্রে শুধু নিসাব পরিমাণে থাকলেই তার উপর ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব হয়ে যায়, চাই সে মাল ব্যবসার হোক বা নাহোক এবং তার উপর বছর অতিবাহিত হোক বা না হোক।

১।ঈদুলফিতরের দিন ফজরের সময় আসার সাথে সাথে সাদাকাতুলফিতর ওয়াজিব হয়। আর যার উপর সাদাকাতুফিতর ওয়াজিব, তার মাল অবশ্যই ঋণ

মুক্ত হতে হবে, এবং মৌলিক প্রয়োজন ও পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ হতে উদ্বৃত্ত হতে হবে।

২। নিত্য প্রয়োজন বলতে শুধু ততটুকু ধর্তব্য, যতটুকু হলে স্বাভাবিক ভাবে জীবন চলে যায়; এক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রয়োজন ধর্তব্য নয়।যেমন থাকার ঘর, ঘরের

আসবাব পত্র, কাপড়চোপড়, বাহন, হতিয়ার এবং কর্মচারী ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অন্তর্ভুক্ত। বিধায় এ সব জিনিসের উপর যাকাত ও সাদাকাতুলফিতর ওয়াজিব নয়।

৩। এক জন ব্যক্তি নিজের ও নিজের সম্পদহীণ শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে সদাকাতুলফিতর আদায় করবেন। আর যদি শিশু সন্তান সম্পদশালী হয় তাহলে তার সম্পদ থেকে আদায় করবেন।

৪। নিজ স্ত্রী ও প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পক্ষ হতে আদায় করা জরুরী নয়। (যদিও তারা তার পরিবার ভুক্ত হয়)

৫। এক বছরের খোরপোশের ব্যবস্থা হয়ে যায় এমন পরিমাণ জায়গা জমি বাদ দিয়ে, বাকি জায়গা জমির মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার উপর সদকাতুলফিতর ও কুরবানী ওয়াজিব।

৬। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিতাবাদী বা বইপুস্তক, পোষাক, বড় বড় ডেগ, উন্নতমানের বিছানা ও চাদর, গদী, শামিয়ানা ইত্যাদির মূল্য যদি নিসাব পর্যন্ত পৌছে তাহলে তার উপর সদাকাতুলফিতর ওয়াজিব।

৭। রেডিও, টেলিভিশন, জরুরী আসবাব নয়, তাই সেগুলোর দাম নিসাবের মধ্যে গণ্য হবে।কমপিউটার যদি শুধু বিনোদনের জন্যে না হয়ে বরং প্রয়োজনীয় তথ্য জানা ও জীবিকা অর্জনের সহায়ক হয় তবে তার উপর যাকাত ও সাদাকাতুলফিতর ওয়াজিব নয়।

৮। সদকাতুলফিতর ঈদের দিন সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার সাথে সাথে ওয়াজিব হয়। সুতরাং সুবহে সাদিকের পূর্বে কোন ব্যক্তি মারা গেলে অথবা সুবহে সাদিকের পর কোন শিশু জন্ম নিলে বা কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তার উপর সাদাকাতুলফিতর ওয়াজিব নয়।

৯। ঈদের দিন ঈদগাহে যাবার পূর্বে সাদাকাতুলফিতর আদায় করা সুন্নত। তবে ঈদের দুএকদিন পূর্বে আদায় করতে চাইলে তা জায়েয আছে। কোন কারণে যদি ঈদের দিন দিতে না পারে তা হলে পরে আদায় করতে পারবে।

১০। কারণ বশত যদি কেউ রমযানে রোযা না রাখে তাহলে তার উপর সাদাকাতুলফিতর ওয়াজিব।

১১। কোন ব্যক্তি চাইলে এক ফকীরকে তার সম্পূর্ণ ফিতরা দিয়ে দিতে পারে। আবার ভিন্ন ভিন্ন ফকীর কেও দিতে পারে।

১২। যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয আছে তাদেরকে ফিতরা দেওয়াও জায়ের। আর যাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই তাদেরকে ফিতরা দেওয়াও জায়েয নেই।

সাদাকাতুলফিতর কি দ্বারা আদায় করবেন?

…………………………..

জানা আবশ্যক যে, সাদাকাতুলফিতর আদায় করার জন্য শরীয়ত মোট পাঁচটি খাদ্য বস্তু নির্ধারণ করেছে। যথা

১।গম

২।যব

৩। খেজুর

৪।কিসমিস

৫।পনির ।

 

খেজুর, পনির, কিসমিস ও যবের ক্ষেত্রে তাকে এক সাঅথবা তার মূল্য আদায় করতে হবে। আর গমের ক্ষেত্রে আধা সাঅথবা তার মূল্য দিলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে, দামের দিক দিয়ে উল্লিখিত খাদ্যদ্রব্যগুলো সমান নয় বরং কোনটার দাম অনেক বেশী আবার কোনটার কম। কেউ যদি সবচেয়ে কম দারেমটা দিয়ে সাদাকতুলফিতর আদায় করতে চায় তা হলে তার সাদাকাতুলফিতর আদায় হয়ে যাবে। তবে নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী বেশী মূল্যের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সাদাকাতুলফিতর আদায় করা উত্তম। কেননা যে যত বেশী মূল্যের খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সাদাকাতুলফিতর আদায় করবে সে ততবেশী সওয়াবের ভাগী হবে। যেহেতু সহীহ হাদীসে গমকেও সদকাতুলফিতর আদায়ের একটি মাপকঠি নির্ধারণ করা হয়েছে, যার পরিমাণ হচ্ছে আর্ধসা, তাই কেউ যদি অর্ধ সাগম বা উহার মূল্য অথবা অর্ধ সাআটা বা তার মূল্য দান করে দেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তার সাদাকাতুলফিতর আদায় হয়ে যাবে।

বর্তমান বাজারে গমের দামই যেহেতু সবচেয়ে কম, তাই ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশপ্রতি বছর অর্ধ সাগমকে সাদাকতুলিফতরের সর্বনিম্ন পরিমাপ হিসাবে নির্ধারণ করে থাকে। আর অর্ধ সাগম বা আটার টাকার অংকটা নির্ধারণ করা হয় ঐ বছরের বাজার দর হিসাবে।

সর্বসাধারণের সুবিধার্থে অর্ধসাগম/আটা/তার মূল্য দিয়ে ফিতরা প্রদানের প্রচলিত নিয়মটি একথা বুঝায় না যে, শুধুমাত্র এজিনিস দিয়েই সাদাকাতুলফিতর আদায় করতে হবে।বরং বিত্তশালীদের একটি বিষয়ে মনোনিবেশ করা দরকার যে, শরীয়ত যে সমস্ত খাদ্যবস্তুকে সাদাকাতুলফিতর আদয়ের মাপকাটি নির্ধারণ করেছে ,সেগুলোর মধ্যে থেকে কোনটি দ্বারা আদায় করলে গরীবদুখীদের সর্বোত্তম খেদমত হয় সে দিকে তারা বিশেষ লক্ষ্য রাখবেন।

কারণ, শরীয়তে সাদাকাতুলফিতর বিধিবদ্ধ হওয়ার যে হিকমতের দিকে হাদীস শরীফে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা হচ্ছে গরীবদুখীদের খেদমত করা

তাই উল্লেখিত বস্তু সমূহের মধ্য থেকে কোনটির মূল্য নির্ধারণ করলে গরীবদুখীদের মৌলিক প্রয়োজন অধিক পরিমাণে পূরণ হয় এবং তারা দুবেলা দুমুঠো খাদ্যখেয়ে মহান আল্লাহ পাকের শুকর আদায় করতে পারে, সেদিকে বিত্তশালীদের লক্ষ্য থাকা উচিৎ ।

 

আধুনিক পরিমাপের আলোকে সা/ অর্ধ সা

……………………………

ক্স১সা = ৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়)

অর্থাৎ ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশী।

তবে গরীবদের প্রতি লক্ষ্য করে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম দেওয়াই উত্তম।

ক্সঅর্ধ সা= ১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম (প্রায়)

আর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশী।

তবে গরীবদের প্রতি লক্ষ্য করে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম দেওয়াই উত্তম।

যে সমস্ত খাদ্যবস্তু দ্বারা সাদাকাতুলফিতর আদায় করা যায়।

.গম (অর্ধ সা= ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম )

.যব (১সা = ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

.খেজুর (১সা =৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

.কিসমিস (১সা =৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

.পনির (১সা =৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

 

দ্রষ্টব্য: যে ব্যক্তি যে শহরে অবস্থান করেন, তিনি সে শহরের বাজার দর অনুযায়ী সাদাকাতুলফিতর আদায় করবেন।

 

নিসাব নির্ণয় করবেন যেভাবে

………………………………………

যাদের কাছে শুধু সোনা (বিশ মিছকাল = সাড়ে সাত তোলা) আথবা শুধু রুপা(দুশ দিরহাম= সাড়ে বায়ান্ন তোলা) নাই। কিন্তু কিছু সোনা, কিছু রুপা এবং নগদ টাকা ও ব্যবসার আসবাবপত্র রয়েছে তারা যাকাতের নিসাব নির্ণয় করবেন নি¤œ রূপে

ক্স শুধু সোনার মূল্য (যদি তা সাড়ে সাত তোলা পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী হয়)

ক্সশুধু রুপার মূল্য (যদি তা সাড়ে বাহান্ন তোলা পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী হয়)

ক্স সোনার মূল্য + রুপার মূল্য (যদি নগদ অর্থ ও ব্যবসাপণ্য না থাকে)

ক্স সোনার মূল্য + নগদ টাকা । (যদি রুপা ও ব্যবসাপণ্য না থাকে)

ক্স সোনার মূল্য + ব্যবসাপণ্যের মূল্য।( যদি তার কাছে রুপা বা নগদ টাকা না থাকে)

ক্স সোনার মূল্য + রুপার মূল্য + নগদ টাকা + ব্যবসাপণ্যের মূল্য । (যখন এ সবের প্রত্যেকটি তার কাছে কিছু কিছু করে থাকবে।)

ক্স রুপার মূল্য + নগদ টাকা। (যখন সোনা ও ব্যবসাপণ্য না থাকবে)

ক্স রুপার মূল্য + ব্যবসাপণ্যের মূল্য। (যখন সোনা ও নগদ টাকা থাকবে)

ক্স রুপার মূল্য + কিছু নগদ টাকা + কিছু ব্যবসাপণ্যের মূল্য।( যখন তার কাছে সোনা না থাকবে)

ক্স ব্যবসার আসবাবের সাথে নগদ টাকা যোগ করবে।( যখন তার কাছে সোনা ও রুপা না থাকবে)

ক্স শুধু নগদ টাকা ( যার পরিমাণ সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমান হবে বা তার চেয়ে বেশী হবে।)

ক্সশুধু ব্যবসাপণ্য (যার মূল্য সাড়ে সাত তোলা সোনা, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমান হয় বা তার চেয়ে বেশী হয়।

 

রচনায়

আব্দুল আহাদ

উস্তাদ, জামিআ ইসলামিয়া মাদীনাতুল উলূম থানাঘাট, শাহজাদপুর।