সোমবার ১০ই সফর, ১৪৪৭ হিজরি ৪ঠা আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সম্মানিত চার মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

মহান আল্লাহ বস্তু জগতে কিছু জিনিসকে অন্য জিনিসের উপর প্রধান্য দিয়েছেন, যেমন মক্কা-মদিনাকে পৃথিবীর সব জায়গার উপর প্রাধান্য দিয়েছেন  তেমনি তিনি বছরের বারো মাসের মধ্যে থেকে চারটি মাসকে পবিত্র ও সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন।

মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সুরা আত-তাওবাহ: আয়াত:৩৬)

এমর্মে রসূর সা. হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন:

হযরত আবূ বকরাহ সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিদায় হজের (হজ্জের) ভাষণে বলেন: মহান আল্লাহ যেদিন আকাশসমূহ এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে কালচক্র একইভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এ চারটি মাসের মধ্যে যুল-কা’দাহ, যুল-হিজ্জা ও মুহাররাম এ তিনটি মাস পরপর রয়েছে। চতুর্থ মাসটি হলো রজবে মুদার, যা জুমাদা ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। (বোখারী ও মুসলিম)

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।
হযরত আবূ বাকরা রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলা যেদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেদিন থেকে কাল তার নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তন করছে– বছরে বারো মাস, তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, যার তিনটি পরপর। সে তিনটি হচ্ছে জিলক্বদ, জিলহজ জিলহজ ও মুহাররাম আর (চতুর্থটি) মুদার গোত্রের রজব মাস, যা জুমাদাল উখরা ও শা’বান মাসের মাঝখানে মাস রযব মাস।

(তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন,) এটি কোন মাস? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম তিনি হয়তো এর (প্রচলিত নাম ছাড়া) অন্য কোনও নাম রাখবেন। (অবশেষে) তিনি বললেন, এটি কি জিলহজ মাস নয়? আমরা বললাম, নিশ্চয়ই।
তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন নগর? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম তিনি হয়তো এর (প্রচলিত নাম ছাড়া) অন্য কোনও নাম রাখবেন। (অবশেষে) তিনি বললেন, এটা কি (মক্কা) নগর নয়? আমরা বললাম, নিশ্চয়ই।
(তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন,) এটি কোন দিন? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম তিনি হয়তো এর (প্রচলিত নাম ছাড়া) অন্য কোনও নাম রাখবেন। (অবশেষে) তিনি বললেন, এটি কি কুরবানীর দিন নয়? আমরা বললাম, নিশ্চয়ই।
তারপর তিনি বললেন, তোমাদের এই মাসে এই নগরে এ দিনটি যেমন মর্যাদাপূর্ণ (যা ক্ষুন্ন করা হারাম), তেমনি তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন–সম্পদ এবং তোমাদের মান–সম্মানও তোমাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ (যা ক্ষুন্ন করা হারাম)। তোমরা অচিরেই তোমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তখন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান! তোমরা আমার পরে কাফের অবস্থায় ফিরে যেও না যে, তোমাদের একে অন্যের গর্দান উড়িয়ে দেবে। শোন! উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। কেননা অসম্ভব নয় যে, যারা এটা (আমার কাছ থেকে) শুনেছে তাদের কতক অপেক্ষা যাদের কাছে পৌঁছানো হবে তাদের কতক বেশি সংরক্ষণকারী হবে।
তারপর তিনি বললেন, বল তো আমি কি পৌঁছে দিয়েছি, বল তো আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? আমরা বললাম, হাঁ (আপনি পৌঁছে দিয়েছেন)। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! সাক্ষী থাকুন। (বোখারী)
এ বর্ণনায় হযরত আবূ বাকরা রাযি. বিদায় হজ্জে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার অংশবিশেষ উল্লেখ করেছেন। ভাষণের এ অংশের মূল আলোচ্য বিষয় মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সে মর্যাদা ক্ষুন্ন করার প্রতি নিষোধাজ্ঞা।

এতে প্রথমে জাহিলী যুগের মানুষেরএকটি কুকর্ম তুলে ধরা হয়েছে। তারা নিজেদের কুমতলবকে সাধন করার জন্য মাসসমূহের মধ্যে নিজেদের ইচ্ছামত তাতে উলটপালট করত। সাধারণত তা তারা করত তাদের স্বার্থের জন্যে। কোনও মাসে তাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা হলে যদি সেই মাসটি সম্মানিত মাসসমূহের একটি হত, তবে তারা ঘোষণা করত এ বছর এ মাসটির বদলে অমুক মাসকে সম্মানিত মাস ধরা হবে। তাদের এ কুমতলবকে মহান আল্লাহ তা‘আলা এ ভাবে বর্ণনা করেছেন:

إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ يُضَلُّ بِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا يُحِلُّونَهُ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَيُحِلُّوا مَا حَرَّمَ اللَّهُ زُيِّنَ لَهُمْ سُوءُ أَعْمَالِهِمْ

এই নাসী (অর্থাৎ মাসকে পিছিয়ে নেওয়া) তো কুফরকেই বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফেরদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়। তারা এ কাজকে এক বছর হালাল করে নেয় ও এক বছর হারাম সাব্যস্ত করে, যাতে আল্লাহ যে মাসকে নিষিদ্ধ করেছেন তার গণনা পূরণ করতে পারে এবং (এভাবে) আল্লাহ যা হারাম সাব্যস্ত করেছিলেন তাকে হালাল করতে পারে। তাদের কুকর্মকে তাদের দৃষ্টিতে শোভনীয় করে দেওয়া হয়েছে। (সূরা তাওবা; আয়াত ৩৭)
তারা তাদের কুমতলব চরিতার্থ করার যে পায়তারা শুরু করেছিলো তা রদ করার জন্যই নবী করীম সা. তার বিদায় হজ্বের ভাষণে পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এবং তাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা যেন আর কখনও ফিরে না আসে তা তিনি তাদেরকে বুঝানোর মাধ্যমে কঠোর ভাবে বারণ করেছেন।

এদিকে ইঙ্গিত করেই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন:إن الزمان قد استدار كهيئته يوم خلق الله السّماوات والأرض

আল্লাহ তা’আলা যেদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেদিন থেকে কাল তার নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তন করছে। অর্থাৎ ওই আবর্তনের ধারায় সম্মানিত মাসসমূহের সম্মান যথারীতি আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
‘আল্লাহ তাআলা যেদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেদিন থেকে কাল তার নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তন করছে।’ অর্থাৎ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মত মাস-বছরের আবর্তন ও কালচক্র আল্লাহ তা’আলারই সৃষ্টি। এটা এমনি-এমনিই হয়ে যায়নি। কাজেই একে এই অর্থে প্রাকৃতিক বিষয় সাব্যস্ত করা সম্পূর্ণ কুফরী যে, এর পেছনে কোনও সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছা কার্যকর নয়; বরং প্রাকৃতিকভাবে এমনি-এমনিই চলছে। এর পর তিনি বলেন:
السنة إثنا عشر شهرا، منها أربعة حرم
‘বছরে বারো মাস, তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’
( حرم হুরুম) শব্দটি حرام -এর বহুবচন। حرام -এর অর্থ দু’টি ১.নিষিদ্ধ ২. মর্যাদাপূর্ণ। বারো মাসের মধ্যে চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। এ সময় ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি ছাওয়াব পাওয়া যায়। আবার এ সময় পাপকর্ম করা অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিকতর জোরদারভাবে নিষিদ্ধ। একসময় এ চার মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহও নিষিদ্ধ ছিল। কুরআন মাজীদে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে।
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ

নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমারা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সুরা আত-তাওবাহ: আয়াত:৩৬)

জুলুম করো না’ মানে পাপকর্ম করো না এবং কোনও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ো না। এ মাসসমূহে যুদ্ধ করা যদিও এককালে নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সে নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়ে যায়। কাজেই এখন প্রয়োজনে এ মাসসমূহে যুদ্ধ করা জায়েয। তবে সর্বাবস্থায়ই এর বিশেষ মর্যাদার প্রতি লক্ষ রাখা চাই।

মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদমুফাসসিরীনেকেরামগণ উক্ত আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন:

১. যারা এই মাসগুলোতে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ভরপুর চেষ্টা করবে তাদের বাকী মাসগুলোতে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক নসীব হবে।

২.যারা এই মাসগুলোতে ইবাদতের ইহতেমাম করে তাদের বাকী মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফীক নসীব হয়।

৩. এই মাসগুলোতে বেশী বেশী ইবাদত আত্মার পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর।

৪. এই মাসগুলোতে কৃত গুনার শাস্তি অন্য মাসের তুলনায় অধিক বেশী।

৫. এই মাসগুলোর ইবাদতে বরকত বেশী হয়।

সম্মানিত মাস চারটি, যথা:-

১। জিলক্বদ ২। জিলহজ¦ ৩। মুহাররম ৪। রজব।

তারপর রসূল সা. ইরশাদ করেন:
ثلاث متواليات : ذو القعدة، وذو الحجة، والمحرم، ورجب مضر الذي بين جمادى وشعبان
তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, যার তিনটি পরপর। সে তিনটি হচ্ছে ১। জিলক্বদ ২। জিলহজ ৩। মুহাররম আর (চতুর্থটি) মুদার গোত্রের ৪। রজব মাস, যা জুমাদাল উখরা ও শা’বান মাসের মাঝখানে।
রজব মাসকে মুদার গোত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত করার কারণ তারা এ মাসকে আরবের অন্যান্য গোত্রের তুলনায় বেশি মর্যাদা দিত। জাহিলী যুগে এ মাসটি উমরার জন্য বরাদ্দ ছিল। নিষিদ্ধ মাসের বাকি তিন মাস হজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালন করত আর এ মাসে তারা উমরা পালন করত। এভাবে এ মাসটিও হজ্জের মাসসমূহের মত নিষিদ্ধ মাসে পরিণত হয়ে যায়।
পবিত্র মাস, পবিত্র নগর ও কুরবানীর দিবস সম্পর্কে সাহাবীগণকে প্রশ্ন এবং এর উত্তরদানে

মাধ্যমে বুঝালেন এগুলো আল্লাহর বিধান মতে পূর্বের ন্যয়ই আছে। কাফেরদের স্বেচ্ছাচারিতায় এতে কোন প্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়নি। বরং এর সম্মান ও মর্যাদা আগের মতেই রয়েছে।

হে আল্লাহ! আমাদের সম্মানিত মসাগুলোর সম্মান বোঝার তাওফীক দাও। ও এমাসগুলোয় যথাযত আমল করার তাওফীক দাও।আমীন।