মুসলমান হিসেবে নিজেদের হায়াতকে দামি বানানোর জন্য আল্লাহ তা‘লার আদেশ মেনে চলা ও নিষেধসমূহ থেকে দূরে থাকা। তবে আল্লাহ তা‘আলা নিজ বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহপ্রিয় হয়ে থেকে থেকে তাদেরকে এমন সুযোগ করে দেন, যেন বান্দা খুব সহজেই তাঁর রেজামন্দী আর্জন করে উঁচু মর্যদার অধিকারী হয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা কিছু কুদরতী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। যেমন; এক জায়গাকে অন্য জায়গার তুলনায় এবং সময়কে অন্য সময়ের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। যেমন মক্কা ও মদীনাকে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন আবার রমাযানের শেষ দশককে এবং জ্বিল হজ্ব মাসের প্রথম দশককে অন্যান্য সময়ের তুলনায় মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
শাবান মাসের অবস্থান: বারটি মাসের মধ্যে থেকে চারটি মাসকে মহান আল্লাহ তা‘আলা সম্মানিত করেছেন এবং মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন সে চারটি মাস যথাক্রমে: জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। সম্মানিত চার মাসের নফল রোজার পরই হচ্ছে শাবান মাসের রোজার অবস্থান।
শাবান মাসকে রসূল সা. পছন্দ করতেন। তাই এমাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন।
শাবান মাস আমল উঠানোর মাস:
সপ্তাহের দুই দিন আল্লাহর সামনে বান্দার আমল পেশ করা হয়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সোমবারে এবং বৃহস্পতিবারে আল্লাহর কাছে বান্দার আমলনামা পেশ করা হয়, আর রোজা অবস্থায় আমার আমল পেশ করা হোক এটাই আমি ভালোবাসি। (তিরমিজী হাদীসটি সহীহ)
হজরত উসামা রা বর্ণনা করেন, ‘একদিন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (শাবান) মাসে বেশি বেশি রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি উত্তরে বললেন, ‘লোকেরা রজব ও রমজান এ দুই মাসের গুরুত্ব বেশি দেয় এবং রোজাও রাখে। কিন্তু মধ্যবর্তী এ মাসটিকে উপেক্ষা করে চলে। অথচ এ মাসেই বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হয়। আমার কামনা হলো- আমার আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করার সময় আমি রোজা অবস্থায় থাকি। এ কারণেই আমি শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখি।’ (মুসনাদে আহমদ, নাসাঈ, আবু দাউদ, বায়হাকী, হাদীসটি হাসান)
চুড়ান্ত আমল নামা পেশ করা হচ্ছে!
এ-মাসে সদাসতর্ক থাকা দরকার! কেননা আমার আমলের চুড়ান্ত তালিকা আল্লাহর সামনে পেশ করার সময় যেন আমি গাফেল না থাকি। তাই এ-মাসে প্রতিটি আমলের প্রতি মনোযোগি হওয়া দরকার। তবেই আশা করা যায় একটি সুন্দর আমল নামার যা আল্লাহর দরাবরে পেশ করা হবে।
মহান আল্লাহ তা‘আলার সমীপে আমাদের লজ্জার উদ্রেক হওয়া চাই:
উল্লিখিত হাদীস থেকে এটাও বোঝা যায় যে, জনাব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসে যাবতীয় এবাদতের প্রতি ঝুঁকে পড়তেন এবং বলতেন; রোজা থাকাকালীন আমার আমল উঠানো হোক এটাই আমি পছন্দ করি। আর আমল উঠানোর সময় এবাদত অবস্থায় না থাকাকে তিনি লজ্জাজনক মনে করতেন। আমলের ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহকে ভিষণ লজ্জা করতেন। তাই এ মাসে তিনি প্রতিটি মুহূর্তে এবাদতে কাটাতেন যাতে মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আমল নামার প্রতি দৃষ্টি দিলে যেন দেখতে পান যে তিনি এবাদতরত অবস্থায় রয়েছেন।
তাই এ উম্মতের সাধারণ থেকে বিশেষ পর্যায়ের সবারই চিন্তা করা দরকার যে, আল্লাহর হাবীব সা. আমল উঠানোর মুহুর্তকে কি দৃষ্টিতে দেখেছেন । বিশেষ করে যারা দ্বীনি দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত তাদের একবার ভাবা দরকার! যে, এ মাসে আমাদের আমলের অবস্থ কি এবং রসূল সা. এ-মাসকে কোন নজরে দেখেছেন আর আমরা কোন নজরে দেখছি? আমাদের এতটুকু তো লজ্জার উদ্রেক হওয়া চাই যে, আল্লাহর কাছে যখন আমদের আমল উঠানো হবে, তখন যেন আমরা এবাদতরত অবস্থায় থাকি। এটা আমাদের ঈমানের এবং রসূল প্রেমের দাবি!
গুনাহ মাফের মাউসূম:
শাবান মাস উম্মতে মুহাম্মদীল জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এমাসে গুনাহগার বান্দাদের জন্য রয়েছে এক বিশেষ সুযোগ। এসুযোগ কে কাজে লাগিয়ে তারা মহান আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় বান্দা হতে পারে। এ মাসে রয়েছে এমন একটি রাত যে রাতে মহান আল্লাহ তা‘আলা সাধরণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। সুনানে ইবনে মাযাতে হযরত আবু মুসা আশয়ারী থেকে বর্ণিত:
حديث أبي موسى الأشعري أن النبي صلى الله عليه وسلم قال:” إن الله ليطلع في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن “. أخرجه ابن ماجة، وقال الألباني: صحيح بمجموع الطرق
তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্যরজনীতে রহমত ভরা দৃষ্টিতে গুনাহগারদের দিকে তাকান, ফলে সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন, একমাত্র মুশরিক ও অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিরেকে।
৫. হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত:
عن معاذ بن جبل رضي الله عنه عن النبي ﷺ قال :
يطَّلِعُ الله الى جميع خلقه ليله النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا لمشرك او مشاحن .
(درجه الحديث : قال الحافظ الهيثمي في المجمع ৮/ ৬৫ رواه الطبراني في الكبير والاوسط ورجالهما ثقات )
(قال محدث السلفيه الألباني المتناقض هو حديث صحيح لشواهده الكثير انظر تعليقه على رساله ليله النصف من شعبان .)
وأخرجه ابن حبان في صحيحه ( الحسان بترتيب صحيح ابن حبان رواه البيهقي في شعب الإيمان (مجمع الزوائد : ৮/৬৫ ) برقم : ৩৬৭৪ ، و الطبراني في المعجم الكبير برقم : ২১৫ ، وفي المعجم الأوسط برقم : ৬৯৬৭ ، وفي مسند الشاميين برقم : ১৯৮ و২০৩ و ৩৪৯৭ والهيثمي في موارد الظمآن إلى زوائد ابن حبان : باب في الشحناء
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্য রজনীতে স্বীয় সৃষ্টির প্রতি বিশেষ করূণার দ্বার উন্মুক্ত করে দেন এবং সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন শুধু মাত্র মুশরিক ও বিদ্বেষী ছাড়া।
মুশরিক ও হিংসুকদের থেকে সতর্ক থাকুন:
যারা শেরেকে লিপ্ত হয়েছে তাদের থেকে আমাদের সতর্ক থাকা চাই । কারণ এ রাতে সাধারণ ক্ষমা থাকার পরও মুশরিকের ক্ষমার কোন সুযোগ নেই। কারণ সে শেরেকের মত যঘন্য মহাপাপ ও মারত্মক অপরাধে জড়িত। আল্লাহ তা‘আলা মহান, তিনি শরীক ও অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র সর্বময় ক্ষমতার মালিক তিনি। কোন কাজ সম্পাদনের জন্য তাঁর কাউকে দরকার হয় না। তাই যারা শেরেক করে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
আর হিংসুক আল্লাহর ক্ষমতা,কুদরত ও তাঁর দানের প্রতি পরিস্কার ধারণা রাখে না। কারণ হিংসুকের এ কথা মোটেও স্মরণ থাকে না যে,‘ মহান আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তাকে, যা ইচ্ছা, তাই দিতে পারেন।’ বিধায় হিংসুকের অন্তর জ্বলাটা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ইরাদা বিরোধী হওয়ার কারণে এই শাস্তি যে, সবাই ক্ষমা পেলেও তার ক্ষমা নেই।
এ রাতে যা বর্জনীয়, শরীয়তে নিষিদ্ধ ও বেদআত:
১.আতশবাজি করা।
২. পটকা ফোটানো।
৩. ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে খামাখা ঘোরাঘুরি করা।
৪.অযাচিত আনন্দ-উল্লাস করা।
৫.বেহুদা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা।
৬.অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো।
৭. হালুয়া-রুটি বা খাবারদাবারের পেছনে সময় ব্যায় করা।
৮.নারী ও পুরুষ এক সাথে গোসল করা ।
৯.মাসজিদ আলোক সজ্জায়-সজ্জিত করা ।
১০.বাড়িঘর ও কবরস্থান মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালানো ।
১১.এ রাতের বিশেষ কোন নামাজ নেই। তাই বিশেষ বিশেষ সংখ্যায় ও পদ্ধতিতে নামাজ পড়া
১২. মিলাদ পড়া।
১৩. দল বেধে কবরস্থান ও মাজারে যাওয়া।
প্রতিদিন আমলের একটি তালিকা তৈরী করুন:
(ফরজ,ওয়াজিব ও সুন্নাতের পাশাপাশি)
১.কিছু ইল্ম শিক্ষা করুন। চার মাজহাবের ইমামগণ এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, নফল এবাদত করার চেয়ে ইল্ম অর্জন করা উত্তম।
২.কিছু দান-সাদকা করুন। (১টাকা করে হলেও ৩০দিনে ৩০ টাকা হবে।)
৩. অল্প করে হাদিয়া দেয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ১টাকা করে জমা করুন ৩০দিনে ৩০টাকা। এবার একটা কিছু কিনে আপনার যাকে ইচ্ছা তাকে হাদিয়া দিন।
হাদিয়ার উপকারিতা: হিংসা দূর হয় হৃদ্যতা বাড়ে।
আলেমদের জন্য সব থেকে বড় বড় হাদিয়া, তাদের কেতাবের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
৪. নফল নামাজ কিছু বাড়িয়ে দিন।
৫. কিছু নফল রোজা রাখা শুরু করুন।
৬. তেলাওয়াতও কিছু বৃদ্ধি করে দিন।
৭. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দরূদ বাড়িয়ে দিন। কমপক্ষে ১০০০ বার।
৮. ইস্তিগফার ১০০০ বার। তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ ( আল-হামদু লিল্লাহ) আরও বাড়িয়ে দিন।
রমাযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন: এ মাসে যাবতীয় এবাদতের প্রতি জাওক ও শাওক বাড়ানো চাই। নফল এবাদতের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া এবং রমাযানের প্রস্ততি মূলক নফল রোজার অভ্যাস গড়ে তোলা।
হে আল্লাহ! আমাদের নেক আমলের তাওফীক দাও।