মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ কথাটির মর্ম আমাদের অনেকেই অজানা। তাই এ বিষয়ে আমাদের পরিস্কার একটা ধারণা থাকা চাই। মানুষ হিসাবে সকল বনী আদমই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবীদার। মহান আল্লাহ পাক সকল মানুষকে সকল সৃষ্টিকুলের মধ্যে সুন্দরতর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। আল্লামা ইবনে আরাবী বলেন:আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে মানুষ অপেক্ষা সুন্দর কেউ নেই। কেননা, আল্লাাহ তালা তাকে জ্ঞানী, শক্তিবান, বক্তা, শ্রোতা, দ্রষ্টা, কুশলী এবং প্রজ্ঞাবান করেছেন। এগুণাবলীগুলো আমরা আর কোন সৃষ্ট মাখলুকের মধ্যে লক্ষ্য করি না। তাই মানুষ নিজ গুণাবলীতে সতন্ত্র। যেমন, মানুষের অবয়বকে আল্লাহ পাক সুন্দর করেছেন পোষাকের মাধ্যমে। সৃষ্ট জীবের মধ্যে শুধু মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের কে মহান আল্লাহ পাক নিজেদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার ক্ষমতা দান করেছেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক মানুষকে করেছেন সম্মানী । সৃষ্টজীবের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করতে জানে, এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক মানুষকে করেছেন সম্মানী । আল্লাহ পাক মানুষকে যে দুইখানা হাত দিয়েছেন এর দ্বারা সে যাবতীয় কর্মকান্ড সুশৃংখল ভাবে পরিচালিত করতে পারে, এটা মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট যা আমরা আর কোন প্রাণীর মধ্যে লক্ষ্য করি না। কাজেই উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে আমাদের বুঝে আসবে যে,সকল বনী আদমই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, চাই মুমিন হোক বা কাফের।
এবার একটা প্রশ্ন জাগে, তাহচ্ছে সকল মানুষই যদি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হয় তাহলে মূসা আ. আর ফিরাউন, ইবরাহীম আ. ও নমরুদ, হযরত মুহাম্মদ সা. ও আবু জাহলের মধ্যে ত আর কোন তফাত থাকে না, কারণ সকল বনী আদমই ত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, আর এনারা ত সবাই বনী আদম, তাই সকলেই ত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। বিষয়টা কি আসলেই এমন! কস্মিনকালেও এমন হতে পারে না; কারণ হযরত মূসা আ. মহযত ইবরাহীম ও হযরত মুহাম্মদ সা. সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ঠিক, কিন্তু ফিরাউন, নমরুদ ও আবু জাহল ত আর নয়। তাই উল্লিখিত সমস্যার সমাধানে উলামায়ে কেরাম বলেন: গুণগত মানুষই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। আর গুণগত মানুষ তারাই যাদের জীবন কোরআনের আলোয় আলোকিত।
মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন:
আর আমি সৃষ্টি করেছি দোজখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ । তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে , তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়ে ও নিকৃষ্টতর তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ। (সূরা- আরাফ; ১৮০)
কাফেরদের না বোঝা, না দেখা ও না শোনার তাৎপর্য:
এ আয়াতে যে সব লোকদের বোঝা, দেখা ও শুনাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে । বলা হয়েছে, এরা কিছুই বোঝেনা, কোন কিছু দেখেও না এবং শোনেও না । অথচ বাস্তবে এরা পাগল বা উন্মাদও নয় যে, কিছুই বুঝতে পারে না। অন্ধও নয় যে কোন কিছু দেখবে না, কিংবা কালাও নয় যে, কোন কিছু শোনবে না। বরং প্রকৃতপক্ষে এরা পার্থিব বিষয়ে অধিকাংশ লোকের তুলনায় অধিক সতর্ক ও চতুর।
কিন্তু কথা হল এই যে, আল্লাহ তালা স্বীয় সৃষ্টিসমূহের মধ্যে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রয়োজন অনুপাতে তার জীবনের লক্ষ্য অনুযায়ী বুদ্ধি ও উপলদ্ধি ক্ষমতা দান করেছেন। এ সবের এক নম্বরে আসে পশু। যাদের জীবনের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রবর্ধন ও চলাফেরা করে খাবার আহরণ , ক্ষতিকর বিষয় থেকে আত্মরক্ষা আর বংশবৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়। এ কারণেই তাদেরকে যে বুদ্ধি, চেতনা ও অনুভুতি দেয়া হয়েছে তা অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় বেশী। কিন্তু ততটুক বেশী যাতে তারা নিজেদের পানাহার , উদরপূর্তি ও নিদ্রা-জাগরণ প্রভৃতি ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে পারে, শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে।
এ সবের পরে আসে মানুষের নম্বর; যার অস্তিত্বের সর্বপ্রথম উাদ্দেশ্য হল নিজের ¯্রষ্টা ও পালনকর্তাকে চেনা, তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী চলা তাঁর অসন্তুষ্টির বিষয় থেকে বেঁচে থাকা সমগ্র সৃষ্টির তাৎপর্যের প্রতি লক্ষ্য করা এবং তার দ্বারা উপকৃত হওয়া, সমগ্র বস্তুজগতের পরিণতি ও ফলাফল উপলদ্ধি করা, আসল ও মেকী যাচাই করে যা ভাল, মঙ্গল ও কল্যাণকর সেগুলোকে গ্রহণ করা, আর যা কিছু মন্দ-অকল্যাণকর সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা।
এ কারণেই মানব জাতি এমন বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয়েছে। এক মাত্র মানুষের মাঝেই এমন গুণ-বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে যে তার কর্মের জন্য ভাল-মন্দ প্রতিদান রয়েছে।যে কারণে তাদেরকে বুদ্ধি জ্ঞান এবং চেতনা-উপলব্ধিও দেয়া হয়েছে সমস্ত সৃষ্টির তুলনায় অধিক। যাতেকরে সাধারণ জীবের স্তরের উর্ধ্বে উঠে নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য মোতাবেক কাজে আত্মনিয়োগ করে।আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ বুদ্ধি, চেতনা ও উপলব্ধিকে এবং দর্শন ও শ্রবণশক্তিকে যেন সেমত কাজে নিয়োগ করে। এই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি সামনে এসে যাওয়ার পর, একজন মানুষের বোঝা, তার দর্শন ও শ্রবণ অন্যান্য জীব-জন্তুর বোঝা, শোনা ও দেখা থেকে ভিন্ন রকম হওয়া উচিৎ। মানুষ যদি নিজের দর্শন, শ্রবণ ও বিবেচোনাশক্তিকে তেমনি কাজে নিয়োগ করে যেমন কাজে নিয়োগ করে থাকে অন্যান্য জীব-জš;‘ তবে বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও তাকে নির্বোধ বলা হবে, চোখ থাকা সত্ত্বেও তাকে অন্ধ এবং কান থাকা সত্ত্বেও তাকে বধির বলে আখ্যায়িত কার হবে।
উক্ত আয়াতে একথা বিবৃত করা হয়নি যে, তারা নিজেদের পানাহার, থাকা-পড়াও নিদ্র্রা-জাগরণ প্রভৃতি জৈবিক প্রয়োজন সম্পর্কেও বোঝে না,কিংবা জৈবিক প্রয়োজন সম্পর্কিত বিষয়গুলোও দেখতে বা শুনতে পায় না। বরং তাদের বুদ্ধিমত্তা ও দর্শনক্ষমতার ব্যবহার যেহেতু শুধুমাত্র সে পর্যায়েই সীমিত ছিল, যে পর্যায়ে সাধারণ জীব-জন্তুর থাকে-অর্থাৎ, শুধু পেট ও দেহের সেবা করা, আত্মার সেবা কিংবা তার তৃপ্তি সম্পর্কে কোন কিছুই না ভাবা বা না দেখাÑসেহেতু তারা এই বৈষয়িকতা ও সামাজিকতায় যত উন্নতি ও অগ্রগতিই লাভ করুক না কেন, চন্দ্র ও মঙ্গলের অভিযানে যত বিজয়ই অর্জন করুক না কেন এবং কৃত্রিম উপগ্রহে সমগ্র নভোমন্ডলকে ভরে দিক না কেন, কিন্তু এসবই পেট ও শরীরের সেবা, তার চেয়ে অধিক কিছু নয়। অত্মার স্থায়ী শান্তি ও তৃপ্তির জন্য এগুলোতে কিছুই নেই।
কাজেই কোনআন তাদেরকে অন্ধ-বধির বলেছে।এ আয়াতে তাদের উপলব্ধি, দর্শন ও শ্রবণকে অস্বীকার করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, তাদের যা বোঝা বা উপলব্ধি করা উচিত ছিল তারা তা করেনি, যা দেখা উচিত ছিল তা তারা দেখেনি, যা কিছু তাদের শোনা উচিত ছিল তা তারা শোনেনি। আর যা কিছু বুঝেছে, দেখেছে এবং শোনেছে তা সবই ছিল সাধারণ জীব-জন্তুর পর্যায়ের বোঝা, দেখা ও শোনা, যাতে গাধা-ঘোড়া, গরু-ছাগল সবই সমান। তাই উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে: أولائك كالأنعام অর্থাৎ, এরা চতুষ্পদ জীব-জানোয়ারেরই মত, কারণ উদর ভরে খাওয়া আর চোখ জুড়িয়ে ঘুমানো আর স্বাধীনভাবে যৌবনের চাহিদা মেটানোই এদের চিন্তার সর্বোচ্চ স্তর। অতঃপর বলা হয়েছে: بل هم أضل অর্থাৎ, এরা চতুষ্পদ জীব-জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ চতুষ্পদ জীব-জানোয়ারের জীবনের কোন লক্ষ্য নাই, এদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, উদর ভরে খাওয়া, আর চোখ জুড়িয়ে ঘুমানো, আর স্বাধীনভাবে যৌবনের চাহিদা মেটানো। আর মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ বুদ্ধি, চেতনা, উপলব্ধি, দর্শন ও শ্রবণশক্তি পাওয়ার পরেও যদি আল্লাহ কে না চেনে, বরং জীব-জানোয়ারের মত উদর ভরে খাওয়া আর চোখ জুড়িয়ে ঘুমানো আর স্বাধীনভাবে যৌবনের চাহিদা মেটানোতেই জীবনের স্বার্থকতা মনে করার কারণেই বলা হায়েছে- أولائك هم الغافلون অর্থাৎ, এরাই হলো প্রকৃত গাফেল।
এবার আসল কথার দিকে আসি, যে সমস্ত মানুষ নবীদের আহবানে সাড়া দিবে এবং তাঁদের উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাবের আলোতে নিজেদের জীবন গড়বে; তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ। আর যারা নবীদের দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে নিজেদের পশুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলবে এরা আকার-আকৃতিতে মানুষ হলেও এরা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। আল্লামা রুমীর ভাষায়-
آدمیت لحم و شحم و پوست نیست+ آدمیت جز رضائے دوست نیست
অস্থি-মজ্জা, রক্ত, গোস্ত ও চামড়া দ্বারা গঠিত দেহকেউ মানুষ বলা হয় না। প্রকৃত মানুষ ত সেই, যে আল্লাহ পাকের রেজামন্দী মোতাবেক চলে।
আশা করি “মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ” কথাটির মর্ম আমাদের ভালভাবে বুঝে আসছে। এবার আমি আপনাদের নিয়ে যাবো বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের আলোচনার দিকে। মহান আল্লাহ পাক কামাগ্নি বা কামশক্তি বা কামপ্রবৃত্তি শুধু মানুষের মধ্যেই রাখেননি বরং সৃষ্টজীবের যত নর-নারী আছে সবার মধ্যেই আল্লাহ পাক তার নিজ প্রজ্ঞায় যতটুকু দরকার ততটুকু দান করেছেন। তাই প্রতিটি সৃষ্টজীব কামকেলী বা যৌন সম্ভোগ করে। রতিমিলনে প্রতিটি প্রাণীর অনাবিল সুখ-শান্তি অনুভব করে। যা ভাষায় কেউ প্রকাশ করতে পারে না। প্রতিটি প্রাণীর রতিমিলন বা যৌনমিলনে পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। এখানে একজন নিপুণ কারিগড়ের নৈপুণ্যতা প্রকাশ পেয়েছে। মহান আল্লাহ পাক সর্বোচ্চ কৌশলী, তাই তিনি তার শিল্পকৌশল ফুটিয়ে তুলেছেন প্রাণীজগতের রতিমিলনে বা যৌনমিলনে।
মানুষ যে সৃষ্টজীবরে শ্রেষ্ঠ, তাই এখানেও রয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্বের বড় প্রমাণ।
(এক) মানুষের মধ্যে আল্লাহ পাক রেখেছের সর্বোচ্চ শক্তিশালী কামভাব বা যৌনশক্তি, যা অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক অনেকগুণ বেশী। প্রাণীসমূহের মধ্যে অনেক প্রাণী এমনও আছে যাদের সপ্তাহে একবার মিলনের চাহিদা জাগে, আবার কোন কোন প্রাণীর মাসে একবার, কোন প্রাণীর বছরে একবার, কোন প্রাণীর ছয় মাস পর একবার, জীবনে শুধু একবার মিলন ঘটায় এমন প্রাণীর সংখ্যাও কম না। প্রক্ষান্তরে মানুষ প্রতিটি মূহুর্তেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি চরম আকৃষ্ট থাকে। ইসলামের শুরুর দিকে রমাযানে স্ত্রী সহবাস নিষেধ ছিল। পরবর্তীতে এ হুকুম রহিত হয়ে এবং রমজান মাসে স্ত্রী সহবাসের অনুমতি প্রদান করা হয়। মুফাসসিরীণেকেরামগণ এর কারণ বর্ণনা করেন যে, দীর্ঘ একটি মাস স্ত্রীদের ব্যাপারে সংযমী হওয়া বড়ই কঠিন ব্যাপার। মানুষের মধ্যে উচ্চমাত্রার কামভাব থাকার কারণে স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকবে, আর মিলন হবেনা এটা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে অন্যান্য প্রাণীদের দিকে আমরা দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই; সপ্তাহ, মাস, বছর ধরে নারী পুরুষ একসাথে থাকলেও তাদের যৌবনের উত্তেজনা তেমনটি পরিলক্ষিত হয় না। হলেও দু-একবার।
(দুই) স্বামী, স্ত্রীর জন্যে, আর স্ত্রী, স্বামীর জন্যে পোশাক বা আবরণের মতো। কারণ পোশাক পরিহিত ব্যক্তিকে যেমন তার পোশাক লুকিয়ে রাখে তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে নানা রকম অন্যায়-অপরাধ থেকে লুকিয়ে রাখে। আমরা সকলেই জানি পোশাক মানুষের দেহের ইজ্জত-আবরু ঢেকে রাখে এবং দেহের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে।
এবার আসাযাক স্বামী-স্ত্রীর মিলনের বিষয়ে। এটা তাদের কেমন গোপন বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা নিশ্চয়! এটা তাদের যারপর নাই গোপন বিষয়। এক্ষেত্রে একে অপরের জন্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পোশাক বলে বিবেচিত হবে। এজন্যে স্বামী-স্ত্রীর মিলন হওয়া চাই একেবারেই নির্জনে-নিরালায়। আর এমন নিভৃত মিলনেই রয়েছে সর্বাধিক সুখ ও শান্তি। পক্ষান্তরে অন্যান্য সৃষ্টজীবের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখতে পাবো তাদের মিলনের জন্যে নির্জনতার দরকার হয় না, বরং যেখানে সেখানেই তদের মিলন হয়। এখানে মানুষ আর পশুর একটা বড় ব্যবধান আমদের দৃষ্টিগোচর হয়।
(তিন) মানুষের মধ্যে মহান আল্লাহ পাক কুদরতী ভাবে যে পানিটা (শুক্র) আমানত রেখেছেন তা সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও অধিক শক্তিশালী। এ পানিতে জোশ আসলে মানুষকে টালমাটাল করে তুলে। মিলনের ক্ষুত-পিপাসা তাকে কাতর বানিয়ে দেয়। এসময় মানব দেহে প্রায় আগুন লেগে যায়, এমন অবস্থায় ধৈর্য ধরার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ পাক। আর ধৈর্যের পানি দ্বারাই একমাত্র এ আগুন নিভানো সম্ভব। ভিন্নপথে গেলেই আযাব তাকে ঘিরে ধরবে। একজন নারী ও পুরুষ এ পানি সংরক্ষণে যত যতœবান হবে, বিবাহ পরবর্তী জীবন তাদের ততই মধুর ও সুখের হবে। উর্বর জমীনে পর্যাপ্ত পানি পাওয়ার কারনে ফসল খুবসুন্দর মনোমুগ্ধকর হবে। আর যারা যত্রতত্র এ পানি অপচয় করবে, বিবাহ পরবর্তী জীবনে নিজ যমীনে যথাযত পানি না দেয়ার কারণে যমীন নষ্ট হয়ে যাবে, অথবা অন্যের দখলে চলে যাবে, আর তার বলার কিছুই থাকবে না। সবার খুব ভালোভাবে স্বরণ রাখা দরকার যে, মিলনে পরিপূর্ণ তিপ্তি পাওয়ার জন্যে উক্ত পানির যথাযত হেফাযত হওয়া দরকার।
(চার) মিলনের সময় বিপরীত লিঙ্গের চেহারা দেখা এবং মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমে একে অপরকে পুলকিত করা ও তৃপ্তি দেওয়ার ক্ষমতা মহান আল্লাহ পাক একমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন।
(পাঁচ) সৃষ্টজীবের মধ্যে একমাত্র মানুষই শুধু তাদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখতে জানে, মানুষ ছাড়া অন্যান্য সকল প্র্রাণী তাদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখতে জানে না, তাদের লজ্জাস্থান সর্বাদা অনাবৃতই থাকে। আর এ কারণে এরা এদের বিপরীত লিঙ্গের বিশেষ অঙ্গ সর্বদাই দেখতে পায়। আর এ কারণেই এদের মধ্যে জৈবিক চাহিদা খুবকম,
দেখবেন অনেক প্রাণী এমনও আছে যাদের সপ্তাহে একবার মিলনের চাহিদা জাগে, আবার কোন কোন প্রাণীর মাসে একবার, কোন প্রাণীর বছরে একবার, কোন প্রাণীর ছয় মাস পর একবার, জীবনে শুধু একবার মিলন ঘটায় এমন প্রাণীর সংখ্যাও কম না। যুক্তিতে চায় মূহুর্তে মূহুর্তে তাদের মিলন হওয়া, কারণ একে অপরের লজ্জাস্থান সর্বদাই দেখে। পক্ষান্তরে আশরাফুল মাখলুকাত আদম সন্তানকে মহান আল্লাহ পাক তাদের সতর ঢাকার নির্দেশ দিয়েছেন। নারীকে আদেশ দিয়েছেন পর্দা করার আর পুরুষ কে আদেশ দিয়েছেন নজর নীচু করার। যারা আল্লাহ পাকের এবিধান রক্ষা করে চলে তারা সর্বোচ্চ রতিশক্তির মালিক হয়। আর যারা এ বিধান রক্ষা করে চলে না তাদের যৌনশক্তি লোপ পায়। ফলে উভয়ে মিলনের প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। তখন তারা দইয়ের স্বাদ ঘোল দিয়েই মিটায়।
(ছয়) বিপরীত লিঙ্গকে সহবাসের উপযোগী করে তোলার জন্যে জীব-জানোয়ারের চিরাচরিত নিয়ম হচ্ছে, এরা এদের মুখ ও জিহ্বাকে ব্যাবহার করে থাকে। বিশেষ অঙ্গে নিজেদের মুখ বা জিহ্বা লাগিয়ে কামভাব জাগিয়ে তুলে। বিপরীত লিঙ্গকে উত্তেজিত করার আর কোন উপায় পশুরা জানে না।
এখানে মানুষের বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন। স্বামী, স্ত্রীকে বা স্ত্রী, স্বামীকে কামউদ্দীপক করার জন্যে আল্লাহ পাক মানুষের মধ্যে রেখেছেন উত্তম উত্তম পন্থা। মানুষের হাত আছে; একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে। চুম্বনের দ্বারা ভালবাসা প্রকাশ করার মত ক্ষমতা মহান আল্লাহ পাক একমাত্র মানুষকেই দিয়েছেন। নারীর পুরা শরীর স্পর্শকাতর। নারীর বিশেষ অঙ্গ ছাড়া সারা শরীরে চুম্বন করা শরীয়তে বৈধ। বিজ্ঞ হাকীমগণ বলেন, নারীর শরীরে চুম্বন দ্বারা তারা শিমাহীন শিহরণ অনুভব করে এবং খুব উত্তেজিত হতে থাকে। হাকীম, ডা. আফতাব আহমদ শাহ তিনি তার গ্রন্থ “আদাবুল মুবাশারাতে” বলেন: নারী শিমাহীন শিহরণ অনুভব করে তখন যখন তার স্তনে চুম্বন করা হয়। এর মাধ্যমে নারী মিলনের অধিক উপযোগী হয়ে উঠে। তিনি আরো বলেন যে, এটা মহান আল্লাহ পাকের প্রাকৃতিক দান। এ অনন্য বৈশিষ্টসমূহ মহান আল্লাহ পাক শুধু মানবজাতীকেই দান করেছেন। তাই ত মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। আশরাফুল মাখলুকাতের বৈশিষ্ট ত আলাদাই হওয়া চাই! তাই এখানেও তার অনন্য বৈশিষ্টসমূহ কত চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে।
তাই প্রতিটি মানুষের এ বিষয়গুলি প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার। বিশেষ করে মুসলিমদের যে, আমরা মুসলিম। আমাদের নিজস্ব আদর্শ ও সভ্যতা আছে। আমাদের আদর্শ ও সভ্যতা মানুষকে নিয়ে যায় সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে।“আমরা মুসলিম” আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। যারা মুসলিম তারাই প্রকৃত মানুষ। তাই আমাদের মুখে এ কথা কখোনো শোভা পায় না যে“স্বামী স্ত্রীর লজ্জাস্থানে, আর স্ত্রী স্বামীর লজ্জাস্থানে মুখ লাগাতে পারবে কি না”। এটা পশু ও জীব-জন্তুর কাজ। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের মিলন কখনও পশুর মত হতে পারে না। প্রাচ্যের ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের এসব স্বভাব থাকতে পারে। তাদের জৈবিক চাহিদা তারা সেভাবেই মিটায় যেভাবে জীব-জন্তু তাদের জৈবিক চাহিদা মিটায়। তাদের স্বভাবের কাছে পশুত্ব হারমানে। তাদের স্বভাবের সাথে মানুষের কোন স্বভাব-চরিত্রের বিচার-বিবেচনা কখনো চলে না। মুসলিম নারী-পুরুষদের স্বরণ রাখতে হবে আমরা“মুসলিম” প্রাচ্যের উতাল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে চলা আমাদের স্বভাব না। আপনাকে আবশ্যই স্বরণ রাখতে হবে যে, আপনার ভবিষ্যত প্রজন্মের ভাল-মন্দ আপনার চরিত্রের উপরই নির্ভর করে। আপনার প্রকৃত পরিচয় ফুটে উঠবে আপনার ছেলে-মেয়েদের দ্বারা।“বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়”। তাই স্বরণ রাখবেন মানবের প্রকৃত স্বভাব-চরিত্র লুকিয়ে আছে ইসলামের মধ্যে তাই এখানেই আপনাকে মানবের প্রকৃত স্বভাব-চরিত্র খুঁজতে হবে।
নতুন দম্পতীদের জন্য
বিবাহ সস্পন্ন হয়ে গেলে নিজ গৃহে রওনা হওয়ার সময় স্ত্রীর হাত ধরে এই দোয়াটি পড়বে।
اللَّهُمَّ إِني أسألُكَ خَيْرَها وَخَيْرَ ما جَبَلْتَها عَلَيْهِ، وأعُوذُ بِكَ مِنْ شَرّها وَشَرِّ ما جَبَلْتَها عَلَيْهِ
বাসরঘরে স্ত্রীর কাছে যাওয়ার সময়কার কিছু আদব।
সহবাসের পূর্বে প্রথমে ১.“বিসমিল্লাহ হির রহমানির রহীম পড়বে”।২. সূরা ইখলাস
,সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়বে। ৩. অতঃপর নি¤েœর দোয়াটি পড়বে।
بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبْ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا
আতঃপর শুক্র স্খলনের সময় এসে গেলে এ দোয়াটি পড়বে।
اللَّهُمَّ لَا تَجْعَلْ لِلشَّيْطَانِ فِيمَا رَزَقَتْنِي نَصِيبًا
তাফসীরবেত্তাগণ বলেন- স্বামী-স্ত্রী প্রাকৃতিক নিয়ম বহির্ভূত কোন পন্থায় মিলন ঘটাবে না, যা ইসলাম সমর্থন করে না, এর বর্ণনা আমি উপড়ে দিয়েছি। সহবাসে পাশবিক পন্থা পরিহার করে চলবে। মানবের প্রাকৃতিক নিয়ম পরিহার করে অন্য পন্থায় সহবাস করাকে হাকীম ও ডাক্তারগণ নিষেধ করেছেন। এতে উভয়ের যার-পরনাই ক্ষতি হয়। এমন মিলনে ছেলে-সন্তান জন্ম নিলে তারা আদর্শবান হয় না। এমন ছেলে-মেয়েদের আখলাক-চরিত্রও ভাল হয় না। তাই স্বামী-স্ত্রীকে আবশ্যই তার ভবিষ্যত প্রজন্মের দিকে লক্ষ্য করে হলেও ইসলামী পন্থায় মিলিত হওয়া চাই।
স্ত্রী সহবাসের সময় কিছু লক্ষণীয় বিষয়:
ভরা পেটে স্ত্রী সহবাস করবে না।* মিলনের উপযোগী সময় শেষরাত। যদি শেষরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে না পারে, তাহলে মাগরিবের পর হালকা খানা খেয়ে নিবে অতঃপর সহবাস করে পরিস্কার হয়ে খানা খাবে। * মিলনের সময় কথাবার্তা না বলা ভাল।* অযূ অবস্থায় সহবাস করা।* বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা।* খুশবু ব্যবহার করা।* সর্বপ্রকার দুর্গন্ধ থেকে দূরে থাকা।* কিবলার দিক হয়ে সহবাস না করা।* একেবারে অনাবৃত না হওয়া।* সহবাস থেকে ফারেগ হওয়ার পর সাথে সাথে পেশাব করে নিবে ও লজ্জাস্থান ধুয়ে নিবে। * মিলনের পর সাথে সাথে পানি পান করবে না। ভালভাবে হাত মুখ ধুয়ে অজু করে নিবে। * সহবাসের কিছু সময় পর, ঘৃতপক্ক খাদ্য,তা না হলে দু-এক দানা মিছরি অথবা ডিম, গাজর ও মধুর হালুয়া, অথবা ফলমুল খেলে শরীরের তেমন ক্ষতি হয় না।