সোমবার ৩রা সফর, ১৪৪৭ হিজরি ২৮শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দাম্পত্য জীবনের শুরু শেষ!

মানুষের প্রকৃত জীবন শুরু হয় বিবাহের মাধ্যমে। মানব জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও ভারী অধ্যায় শুরু হয় বিবাহের মাধ্যমে। এ জীবনে জটিল কোন সমস্যা দেখা দিলে অশান্তির অলন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। এর প্রভাব পড়ে দেশ, সমাজ ও নিজের ভবিষ্যত প্রজন্মের উপর। আর দাম্পত্য জীবনে অশান্তি দ্বারা বহুমুখী অন্যায়ের দার খুলে যায়। তাই কুরআন ও সুন্নাহয় রয়েছে দাম্পত্য জীবনের বিশেষ দিক নির্দেশনা।

যারা এই দিক নির্দেশনা না মেনে, স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে অমুসলিমদের সভ্যতা মতে দাম্পত্য জীবন গড়ে তুলে তারা কস্মিনকালেও সুখের কনাও দেখতে পাবে না। বরং তারা সবসময় অশান্তির দাবানলে জ্বলবে।

যারা সারা পৃথিবীতে নারীদের স্বাধীনতা দেয়ার ঠিকাদারি নিয়েছে এবং নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য তাদেরকে মাঠে নামিয়েছে; তাদের অন্দরমহলে একবার দৃষ্টি ফেরান যে, তাদের নারীরা কতটা স্বাধীন এবং কেমন অধিকার পাচ্ছে!

পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার দিতে গিয়ে নারীদের বানিয়েছে পুরুষদের ভোগের পণ্য। আর তাদের এ স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের জন্য প্রথমে তাদের কৃত্রিম পুরুষ সাঁজতে হয়।

চলুন একটু দেখে আসি পশ্চিমা নারীরা কেমন সূখে আছে! তাহলে কথায় কথায় যারা পশ্চিমা নারীদের তুলনা দেয় এবং বলে, ‘তাদের পারিবারিক জীবন প্রচুর আনন্দময় ও সুখের’ তাদের কিছুটা হলেও শিক্ষা হবে এবং বাস্তবতা বোঝার বোধোদয় হবে।

‘মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ প্রকাশিত তথ্য মতে পারিবারিক সমস্যার কারণে ৪০% স্ত্রী হত্যার ঘটনা ঘটে। আর ২৫ % ঘটে পারিবারিক বিরোধের আগেই। ‘আমেরিকান টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছে’ ছয় মিলিয়ন স্ত্রী, স্বামী কর্তৃক বহুমুখী নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। আর বাড়ি-ঘরের সহিংসতার  ঘটনার পেছনে তৃতীয়ংশ সময় দিতে হয় পুলিশকে।

এই গবেষণার লেখক ইভান স্টাক (১,৩৬০০) মহিলার কল রেকর্ড পরীক্ষা করে বলেছিলেন যে, আমেরিকাতে মহিলাদের উপর এধরণের আঘাত সবচেয়ে বেশি।

ওয়াশিংটনে অবস্থিত ঘরোয়া সহিংসতাবিরোধী ‘ন্যাশনাল কোয়ালিশন অর্গানাইজেশন-এর সমন্বয়ক জেনিস মুর বলেছেন : এই ভয়াভহ ট্র্যাজেডি এক বিশাল আকারে পৌঁছেছে; স্বামীরা আমেরিকা জুড়ে মহিলাদের মারধর করে, তাদের বেশিরভাগই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়।

তিনি আরও বলেন ভয়াবহ বিষয়টি হলো আরও অনেক মহিলা রয়েছেন যারা স্বামীর হাতে আহত হয়েছেন, তবে তারা চিকিতৎসা নিতে হাসপাতালে যান নি বরং তারা নিজেরাই বাড়িতে ব্যান্ডেজ করে রেখেছিলেন।

তিনি আরো বলেন: আমাদের অনুমান হয় যে, প্রতিবছর ‘ছয় মিলিয়ন’ মহিলাদেরকে তাদের বাড়িতে পেটানো হয়েছে। এবং আমরা এফ,বি,আই এর ফাইল থেকে এবং শত শত আশ্রয় কেন্দ্র থেকে এমন তথ্য সংগ্রহ করেছি।

ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে ৭৭২ জন মহিলা প্রাণ হারিয়েছে স্বামীর নির্যাতনে।

কানাডার একটি সামাজিক গবেষণা দেখা গেছে যে, সেখানে আট মিলিয়নেরও বেশি মহিলা প্রতি বছর নির্যাতনের শিকার হন।

ব্রিটেনে, লন্ডন পুলিশই কেবল গত পনের বছর ধরে তাদের স্বামীদের দ্বারা মারধর করা মহিলাদের কাছ থেকে বছরে এক লক্ষ কল পেয়ে থাকে।

আমেরিকাতে প্রতি আট সেকেন্ডে একজন মহিলার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়।

প্রতি বছর এক লক্ষ জার্মান মহিলা তাদের স্বামীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।

প্যারিসের পুলিশ বাহিনী রাতের বেলা প্রাপ্ত ফোনগুলির মধ্যে ৬০% ফোন কল পান  নির্যাতিত নারীদের সাহায্যের জন্য ।

এই পরিসংখ্যানগুলি উল্লেখ করার কোন প্রয়োজনই ছিলো না। কারণ কুফুরির থেকে আর বড় কোন পাপ নেই। তাই কাফেরদের দ্বারা বহুমুখী অপরাধ সংঘটিত হতেই পারে।

কিন্তু যারা নিজেদের বুদ্ধিজিবী বলে অভিহিত করেন যারা পশ্চিমা সভ্যতার অন্ধভক্ত।  পশ্চিমাপ্রীতি তারেদ স্বভাবে মিশে গেছে। কথায় কথায় পশ্চিমাদের টেনে না আনলে তাদের পেটের ভাত হজম হয়না, তারা যেন প্রকৃত বিষয়টা ভাবতে শিখেন এ জন্যই  পশ্চিমা নারীদের কথিত অধিকার ও স্বাধীনতার কিছু চিত্র তুলে ধরলাম!

যারা অন্ধ; তাদেরকে কিছু বলার নেই, কিন্তু জ্ঞানীদের তো শিক্ষা নেয়া চাই।

নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার একমাত্র ইসলামই দিয়েছে:

ইসলাম নারীকে তার পূর্ণ অধিকার দেয় এবং সম্মনের সুউচ্চ আসনে সমাসিন করে। আর পশ্চিমারা নারীকে কিছু অধিকার দেয় বটে, তবে তাদের কৃত্তিম পুরুষ সেঁজে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার পর তার আগে নয়!?   বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা মহিলাদের দিকে তাকান এবং দেখেন যে, তারা সামান্য অধিকারে জন্যে নিজেদের সতীত্ব জলাঞ্জলী দিয়েছে এবং নিজেদেরকে তাদের হাতের পুতুল বানিয়েছে আর এটাকেই তারা তাদের সুখের চরম চাওয়া-পাওয়া মনে করছে?

দাম্পত্য জীবন সুখের হয় কখণ:

দাম্পত্য জীবনকে সুখকর করতে চান? তাহলে দাম্পত্যপূর্ব জীবনকে ইসলামের আলোকে সাজান।

ইসলাম অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ও পরনারীর প্রতি আসক্তি হওয়াকে বিকৃত মানসিকতা ও মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ বলে মনে করে। তাই কোন গর্হিত কাজকে ইসলাম অনুমোদন দেয় না। আর বিবাহবহির্ভূত নারী-পুরুষের আসক্তি কিংবা সম্পর্ক সবচেয়ে যঘন্য ও গর্হিত নিষিদ্ধ কাজ।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীর জন্য ‘ঘনিষ্ঠ আত্মীয়’ দেবরকে (স্বামীর ভাইকে স্ত্রীর জন্য) মৃত্যুর সমতুল্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ঠিক স্বামীর জন্য স্ত্রীর বোনও (শ্যালিকাও) অনুরূপ।

দেবর কিংবা শ্যালিকার ব্যাপারে যদি ইসলামের এ রকম কঠোর নির্দেশনা আসে তবে পরনারী কিংবা পর পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান কেমন হতে পারে? তা বিবেকবানদের জন্য অনুমেয়।

عن معقل بن يسار رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لأن يطعن في رأس أحدكم بمخيط من حديد خير له من أن يمس امرأة لا تحل له قال الألباني رحمه الله تعالى: رواه الطبراني والبيهقي ورجال الطبراني ثقات رجال الصحيح

হযরত মা‘কিল ইবনে ইয়াছার রা. বলেন,রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের কারো মাথায় লোহার পেরেক ঠুকে দেয়া ওই নারীকে স্পর্শ করা থেকে অনেক ভাল, যে নারী তার জন্য হালাল নয়।’ (বায়হাকী,তাবারানি)

ইসলামে বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক, আসক্তিমূলক আচরণ, সামাজিকতার নামে অসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ফাহেশা কথা-বার্তা বা চ্যাটিং সবই হারাম তথা নিষেধ।

যৌন সম্পর্ক, অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা তো দূরের কথা, বিবাহবহির্ভূত নারী-পুরুষের কোমল বা মিষ্টি ভাষায় কোন প্রকার কথা-বার্তা বলা যাবে না। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ভাষায় ঘোষণা করেন:

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا ৩২

হে নবী নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও;যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর,তবে পরপুরষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না,ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে,যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তারা তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। বরং তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। (সূরা আহযাব-৩২)

বিবাহপূর্ব জীবনে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ মেনে চলেছে তাদের জন্য রয়েছে মহান আল্লাহ তা‘লার পক্ষ্য থেকে  দাম্পত্য জীবনে এক মহাপুরস্কার।

মহান আল্লাহ তা‘আলার ভাষায় সেই পুরস্কারের ঘোষণা:

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সুরা রূম:২১)

আয়াতে উল্লিখিত পুরস্কারের নাম হচ্ছে“মুআদ্দা” ও “রহমাহ”

مَوَدَّة এর অর্থ হল স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুমধুর ভালবাসা যা সাধারণত পরিলক্ষিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেরূপ ভালবাসা সৃষ্টি হয় অনুরূপ ভালবাসা পৃথিবীর অন্য কোন দুই ব্যক্তির মাঝে হয় না। আর رَحمَة (মায়া-মমতা) হল এই যে, স্বামী নিজ স্ত্রীকে সর্বপ্রকার সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশ দান করে থাকেন। অনুরূপ স্ত্রীও নিজের সাধ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী স্বামীর সেবা করে থাকে।

মহান আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের উপরেই সেই দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। বলা বাহুল্য, মানুষ এই শান্তি ও অগাধ প্রেম-ভালবাসা সেই দাম্পত্যের মাধ্যমেই লাভ করতে পারে যার সম্পর্কের  ভিত্তি শরীয়তসম্মত বিবাহের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। উপরন্তু ইসলাম একমাত্র বিবাহসূত্রের মাধ্যমেই সম্পৃক্ত দম্পতিকেই জোড়া বলে স্বীকার করে।

আমাদের কল্পনা তাঁর পরিকল্পনা মতে হলেই হবে পরিবার পরিকল্পনা:

মহান আল্লাহ তা‘আলা নিজেই পরিকল্পিতভাবে এ ব্যবস্থা করেছেন যার ফলে একজন অজানা নারী-পুরুষের মাঝে গভীর সম্পর্ক স্থাপন হয়ে যায়, মনে হয় যেন তাদের মাঝে রয়েছে হাজারও বছরের পুরান প্রীতি, ভালোবাস,মায়া ও মুহাব্বত!

যারা নিজেদের জীবন-যৌবনকে আল্লাহ তা‘আলার আমানত বলে একটি দিনের মিলনের অপেক্ষায় থাকবে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হওয়ার সাথে সাথে মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রক্ষিত পার্সোনাল “ مَوَدَّة ও  رَحمَة ” তাদের মাঝে দিয়ে দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে পাওয়া মুআদ্দা “مَوَدَّة ও رَحمَة” দিয়ে যাদের জীবন শুরু হয়, তাদের দাম্পত্য জীবনটা আল্লাহ তা‘আলার একটা নিদর্শন বনে যায়, যা একটা বিজ্ঞানময় ব্যবস্থাপনা। এবং এটাকে মহান আল্লাহ তা‘আলা মানব বংশধারা অব্যাহত থাকার এবং অন্যদিকে মানবিক সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অস্তিত্ব দান করার মাধ্যমে পরিণত করেছেন ।

স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য:

এ জীবনে যে কোন মূহুর্তে কোন চড়াই-উতরাই আসতেই পারে, আবার কোন বাধা তাদের সামনে আসতেই পারে, তাই বলে দুজনকে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এমন অবস্থায় তাদেরকে কুরআন-সুন্নার দারস্থ হতে হবে এবং কুরআন-সুন্নাহ তাদেরকে যে দায়িত্ব ও অধিকার দিয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি ফেরাতে হবে।

স্ত্রীকে কখনও ছোট চোখে দেখার সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদেরকে বলেছেন:

وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللّهُ عَزِيزٌ حَكُيمٌ

আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীরদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। (সুরা বাকারা:২২৮)

স্ত্রীদের উচিৎ হবে তারা তাদের অধিকার নিশ্চিত করবে:

তারা কখনও অনধিকার চর্চায় যাবে না। সমান অধিকারের ¯েøাগান দিয়ে নিজেদেরকে কখন অধিকার থেকে বঞ্জিত করবে না। পশ্চিমা নারীরা সমান অধিকার আদায় করতে গিয়ে আজকে তারা অধিকার থেকে বঞ্জিত। সাথে সাথে তারা আজকে পরাধিনতার গøানি নিয়ে জুলুম ও নির্যাতনের জীবন-যাপন করছে।

তাই আল্লাহ তা,আলা তাদেরকে অনধিকার চর্চা করতে নিষেধ করেছেন।

وَلاَ تَتَمَنَّوْاْ مَا فَضَّلَ اللّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبُواْ وَلِلنِّسَاء نَصِيبٌ مِّمَّا اكْتَسَبْنَ وَاسْأَلُواْ اللّهَ مِن فَضْلِهِ إِنَّ اللّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا

আর তোমরা আকাক্সক্ষা করো না এমন সব বিষয়ে যাতে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের একের উপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। (সুরা নিসা ৪:৩২)

পুরুষ নারীর কর্তা:

পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য পুরুষকেই নারীর কর্তা বানানো হয়েছে। স্বামীর আনুগত্য করা দুর্বলতার লক্ষণ নয় বরং এটা বড় ইবাদত ও পারিবারিক দায়িত্ব।  তাই মহান আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন।

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاء بِمَا فَضَّلَ اللّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُواْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ

পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের এককে অন্যের উপর মর্যাদা প্রদান করেছেন, আর এজন্য যে, পুরুষরা স্বীয় ধন-সম্পদ হতে ব্যয় করে।

(সুরা নিসা;৩৪)

যেহেতু পুরুষ ও নারীদের অধিকার পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ, বরং পুরুষের তুলনায় নারীদের দুর্বলতার কারণে তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ নারীরা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে পারে না।

একজন নারীর মর্যাদ ও সম্মান রয়েছে তার স্বামীর আদেশ পালনে ও তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শনে। তাই রসূল সা. বলেন:

قال النبي عليه الصلاة والسلام : لو أمرت أحداً أن يسجد لأحد لأمرت المرأة أن تسجد لزوجها

আল্লাহ ব্যতীত যদি অন্য কাউকে আমি সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে তার স্বামীকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম। (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ; হাদীসটি সহীহ)

অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সবচেযয়ে উত্তম নারী হল ঐ স্ত্রী যার দিকে তুমি তাকালে তোমাকে সে খুশী করে। তাকে নির্দেশ দিলে আনুগত্য করে। তুমি তার থেকে অনুপস্থিত থাকলে সে তার নিজেকে এবং তোমার সম্পদকে হেফাযত করে। (মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরাকে হাকেম)

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, স্বামীর এমন ভক্তি ও শ্রদ্ধার মধ্যে সব থেকে বড় হেকমত হলো পরিবার টিকিয়ে রাখা। আর স্বামীর আনুগত্য করা দুর্বলতার লক্ষণ নয় বরং এটা বড় ইবাদত ও পারিবারিক দায়িত্ব।

স্ত্রী যদি অবাধ্য হয় তখন করণীয় কি:

কোন স্ত্রী যদি অবাধ্য হয় তাহলে স্বামীকে প্রথম ধাপে আল-কোরআন তিনটি কাজ করার আদেশ দিয়েছে:

মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

وَاللاَّتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلاَ تَبْغُواْ عَلَيْهِنَّ سَبِيلاً إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا

আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ।(সুরা নিসা ৩৪)

 স্ত্রী অবাধ্য হলে করণীয়:

সর্বপ্রথম তাকে সদুপদেশ ও নসীহতের মাধ্যমে বুঝাতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ সাময়িকভাবে তার সংসর্গ থেকে পৃথক হতে হবে। বুদ্ধিমতী মহিলার জন্য এটা বড় সতর্কতার বিষয়। কিন্তু এতেও যদি সে না বুঝে, তাহলে

তৃতীয় নম্বরে হাল্কাভাবে প্রহার করার অনুমতি আছে। তবে এই প্রহার যেন হিং¯্রতা ও অত্যাচারের পর্যায়ে না পৌঁছে; যেমন অনেক মূর্খ লোকের স্বভাব। মহান আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (সাঃ) এই যুলমের অনুমতি কাউকে দেননি।

রাসূলুল্লাাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেছেন;

لا يضربُ أحدُكم امرأتَه ضربَ الأمةِ ثم يضاجعُها

তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে চাকর-বাকরদের মত না মারে, পরে সে দিনের শেষে তার সাথে আবার সহবাস করল। (বুখারী)

অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগতা হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোন পথ অন্বেষণ করো না’ অর্থাৎ, তাহলে আর মারধর করো না, তাদের উপর সংকীর্ণতা সৃষ্টি করো না অথবা তাদেরকে তালাকও দিও না।

তৃতীয় নম্বর প্রন্থা অবলম্বনের পরও যদি সমাধান না হয়:

চতুর্থ নম্বনে আল্লাহ তা‘আলা আদেশ দিয়েছেন একটি সালিসি বৈঠকের। উভয় পরিবারের জ্ঞানীরা বসে সিদ্ধান্ত নিবে যে, এহেনও পরিস্থিতিতে কল্যাণের পথ কোন টি। এমর্মে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُواْ حَكَمًا مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا إِن يُرِيدَا إِصْلاَحًا يُوَفِّقِ اللّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا

যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতির আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ের মীমাংসা চাইলে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত।( সুরা নিসা:৩৫ )

 

স্বামী-স্ত্রীর অভিজ্ঞতার অভাব থাকার কারণে জ্ঞানী মুরব্বীদের পরামর্শে তারা নতুন করে জীবন শুরু করবে। এরপরও যদি বনিবনা না হয় তাহলে একজন বিজ্ঞ আলেমের দারস্থ হয়ে শুধু একটি তালাক দিবে আর এটা হল পঞ্চম নম্বর ধাপ।

তালাক প্রসঙ্গে কিছু জরুরী কথা আমাদের স্মরণ রাখা দরকার:

প্রথমত তালাকের কথা চিন্তাও করবে না:

অর্থাৎ, তালাক হল একেবারে শেষ ধাপ; যখন আর কোন উপায় থাকবে না, তখন তার প্রয়োগ হবে। কিন্তু বহু স্বামী  এই শেষ ধাপকে প্রথমেই ব্যবহার করে থাকে। যার কারণে বহুমুখী অন্যায়ের পথ খুলে যায়।

তালাক প্রদানের ক্ষমতাকে শরীয়তের নির্ধারিত নীতিমালার বাইরে ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিধানের সাথে বালখিল্যতার শামিল। আর শয়তান মানুষকে তখনই গ্রাস করতে পারে যখন, সে শরীয়তে বাইরে পা রাখে।

তবে অতীব প্রয়োজনে কখনো তালাক প্রদানের প্রয়োজন হলে দ্বীনদার আলেমের দারস্থ হয়ে শুধু সাদামাটা এক তালাক দিবে।

মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা ভাবনা করে তালাক দিন:

স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা একটি গভীর ভালোবাসা যা ভেঙ্গে গেলেও আবার জোড়া লাগার সম্ভাবনাই বেশী,তাই এক সাথে বা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তিন তালাক দিয়ে এটাকে একে বারে অযোগ্য করে দেওয়াটা মোটেও ঠিক হবে না। যেন উভয়ের জন্যই নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ থাকে এবং পুনরায় ফিরে আসার পথ খোলা থাকে তাই উল্লিখিত চতুর্থ ধাপ অনুসরণের পর ঠান্ডা মাথায় পঞ্চম ধাপে পা রাখবে।

তালাক একটি স্পর্শকাতর বিষয়:

তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি বিবেচক স্বামীর দায়িত্ব হল, তালাকের শব্দ কিংবা এর সমার্থক কোনো শব্দ মুখে উচ্চারণ করা থেকে সতর্কতার সাথে বিরত থাকবে।

তালাকের সাথে ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করা:

তালাকের সাথে ‘বায়েন’ শব্দ ব্যবহার করবে না। কেউ ‘বায়েন’ শব্দ বলে ফেললে (চাই তা এক বা দুই তালাক হোক না কেন) নতুন করে শরীয়ত সম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো ছাড়া স্ত্রীর সাথে পুনরায় মিলনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু শুধু ‘তালাক’ দ্বারাই উদেশ্য হাসিল হয়ে যায়, বিধায় ‘বায়েন’ শব্দ যা বিবাহকে একে বারে নষ্ট করে দেয় তা কখনও ব্যবহার করবে না। তবে অতীব প্রয়োজন হলে দ্বীনদার আলেমের দারস্থ হয়ে তার পরামর্শ মতে সেটা ব্যবহার করবে অন্যথায় নয়।

তিন (৩) সংখ্যা ব্যবহার করে তালাক:

অনুরূপভাবে ৩ সংখ্যা দিয়ে তালাক দিয়ে ফেললে বা-একই মজলিসে পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক দিয়ে দিলে – যেমন বলল, তোমাকে তিন তালাক দিলাম। বা বলল, তোমাকে এক তালাক, দুই তালাক তিন তালাক অথবা আগে কখনো দুই তালাক দিয়েছিল আর এখন শুধু এক তালাক দিল। তাহলে সর্বমোট তিন তালাক দেওয়া হল। যেকোনো উপায়ে তিন তালাক দেওয়া হলে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় শুধু মৌখিকভাবে স্ত্রীকে বিবাহে ফিরিয়ে আনার যেমন কোনো সুযোগ থাকে না তেমনি নতুন করে বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেও ফিরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না।

একসাথে  তিন তালাক একটি জঘণ্য অপরাধ ও ঘৃণিত কাজ:

একসাথে তিন তালাক দেওয়া কিংবা বিভিন্ন সময় তালাক দিতে দিতে তিন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া একটি জঘণ্য অপরাধ ও ঘৃণিত কাজ। আল্লাহ তা‘আলা এর শাস্তি হিসেবে এই বিধান দিয়েছেন যে, তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পুনরায় একসাথে বসবাস করতে চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর অন্যত্র তার বিয়ে হওয়া এবং সে স্বামীর সাথে তার মিলন হওয়া অপরিহার্য। এরপর কোনো কারণে সে তালাক প্রাপ্তা হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত পালনের পর এরা দুজন পরস্পর সম্মত হলে নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।

এজন্য শরীয়ত আগেই সাবধান করে দিয়েছে যে, খবরদার তিন তালাক যেন না হয়।

তিন তালাক ছাড়া কি তালাক হয় না?

এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল যে তালাক দেয়ার সময়  ‘বায়েন’ শব্দ এবং দুই ও তিন সংখ্যা যোগ না করলে তালাকই হয় না। যেমন, কেউ কেউ মনে করে যে, শুধু এক বা দুই তালাক দেওয়ার দ্বারা তো তালাকই হয় না। তালাকের জন্য একসাথে তিন তালাক ও বায়েন তালাক দেওয়াকে তারা অপরিহার্য মনে করে।

তাই বিবাহের পূর্বে তালাক ও বিবাহের শরঈ নীতিমালাগুলো প্রত্যেক ব্যাক্তিকে জরুরী ভিত্তিতে শিখে নিতে হবে।

একসাথে তিন তালাক দেওয়া জায়েয না হলেও কেউ যদি এই নাজায়েয কাজ করে তাহলে তার স্ত্রীর উপর তিন তালাক ঠিকই পতিত হয়। এক্ষেত্রে তার মৌখিকভাবে রুজু করার অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি নতুন করে বিবাহ দোহরিয়ে নেওয়ার দ্বারাও তারা একে অপরের জন্য হালাল হতে পারে না। তাই সকল স্বামীরই কর্তব্য, প্রথম থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। মুখ দিযয়ে কখনো তিন তালাক কিংবা তালাক, তালাক, তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর আগেই দুই তালাক দিযয়ে থাকলে এখন আর তৃতীয় তালাকের চিন্তাও না করা।

ডিভোর্সের শরঈ নীতি মালা: ডিভোর্সের অর্থ হচ্ছে; বিবাহবিচ্ছেদ, তালাক, সংযোগছেদ বা সম্পর্কের বিলুপ্তি বা অবসান। আমাদের দেশে ডিভোর্স বলতে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীমে তালাক দেয়া বুঝায়। আমরা মুসলমান হলেও এর শুদ্ধতা কখনও যাচাই করিনি যে, ডিভোর্সেল মাধ্যমে যা হচ্ছে তা শরীয়ত সম্মত কি না। মূলত ডিভোর্স বলা হয়‘ক্ষমতাবলে তালাক গ্রহণ করাকে যেটাকে (তালাক-ই-তৌফিজ)’ও বলা হয়। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবাবিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী এটি এখতিয়াভূক্ত করা হয়। তখনকার ১৮ নং কলামের ভাষা ছিলো নিম্বরূপ:

( آیا شوہر  نے طلاق کا حق بیوی  کو تفویض کر دیا ہے؟ اگر ہے تو کن شرائط کے تحت؟)

অর্থ; স্বামী স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন কী না, দিয়ে থাকলে কী কী শর্তে।

আর বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিষ্টেশন আইন হয়, সেখানে ১৮ নং কলামের বাংলা করা হয় নি¤œরূপ:

স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করছে কি না? করে থাকলে কী শর্তে?” ১৮ নং কলামের যে বাংলা করা হয়েছে তা অশুদ্ধ।

এই কলামে সাধারণত  দুইটি ভূল দৃষ্টিগোচর হয়

প্রথম: ১৮ নং কলামে তো মূলত “তালাক-ই-তাফবীজ”এর  বাংলা অর্থটা বসবে। “তালাক-ই-তাফবীজ” বাংলা অর্থ  হচ্ছে; “স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের অধিকার দেয়া” এবং স্ত্রী, স্বামীর দেয়া সেই ক্ষমতাবলে তালাক গ্রহণ করা। আর ১৮ নং কলামে বলা হচ্ছে: স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করছে কি না? করে থাকলে কী শর্তে?” ইসলাম ধর্মে তো স্ত্রী কস্মিনকালেও তালাক প্রদানের ক্ষমতা রাখে না। বরং তালাক গ্রহণ করতে পারে।

দ্বিতীয়ত: সঙ্গত কারণে যদি শর্তযুক্ত করতে হয়, তাহলে দুপক্ষ আগেই বলে নিবে যে, আমরা শর্তযুক্ত বিবাহ করতে চাই। এবং শর্তনামায় পরিস্কার লেখা থাকবে কি কি শর্তেল ভিত্তিতে কি স্বামী কোন ধরণের তালাক গ্রহণের অনুমতি প্রদান করলেন। এবং নিকাহ রেজিষ্টারার তার বইতে কেবল মাত্র সেই শর্তনামাটাই লিখতে পারবে। নিজের পক্ষ থেকে সে কিছুই লিকতে পারবে না।

আর যে বিবাহগুলো শর্তহীন হবে সেখানে কোন প্রকার শর্ত থাকবে না এবং নিকাহ রেজিষ্টারার কোন প্রকার শর্ত লিখতেও পারবে না।

প্রক্ষান্তরে অনেক কাজী নিকাহনামার কলামগুলো পূরণের জন্য নিজে থেকে একটা গদবাধা ভাষ্য তৈরি করে নেয়। বিশেষ করে ১৮ নং কলামটি পূরণের ক্ষেত্রে তো কেউ কেউ নির্দিষ্ট বাক্য সম্বলিত সিলমোহরও বানিয়ে নেয়। এরপর ঢালাওভাবে সকল কাবিননামায় ওই গদবাধা ভাষ্যই ব্যবহার করে। কোনো বর যদি এর বিপরীতে তার নিজের দেয়া কোনো কথা লিখতে বলে তখন কাজীরা তা লিখতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বলে, এভাবে লেখা নিয়ম না। আমি এভাবে লিখতে পারবো না। অন্যান্য কাবিনে যা লিখি আমাকে তা-ই লিখতে হবে।

কাজীদের উক্ত কথা সম্পূর্ণ ভুল। ১৮ নং ধারাটি একটি ধর্মীয় বিষয়, যা ধর্র্মীয় আইন মতেই হবে এতে এতে নিকাহ রেজিষ্টারারদের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।

স্ত্রী কোন ধরণের তাকাল গ্রহণ করতে পারবে:

বিবাহের পূর্বে শর্তমতে যে  তালাক গ্রহনের অনুমতি স্বামী স্ত্রীকে দিয়েছিলো স্ত্রী কেবল মাত্র সেই তালাকই গ্রহণ করতে পারবে।

উদাহরণ স্বরূপ, স্বামী, স্ত্রীকে যদি ‘এক তালাকে বয়ান’ গ্রহণের অনুমতি প্রদান করে থাকে তাহলে সে শুধু এক তালাকে বয়ানই গ্রহণ করতে পারবে। সুতরাং স্ত্রী যদি এখন তাকে তিন তালাকের নোটিস পাঠায় তাহলে তা কখনও গ্রহণ যোগ্য নয়।

বিধায় শরীয়তের বিধানকে এভাবে বিকৃত করার অধিকার কারও নেই।

এখানে আরও একটি বিষয় আমাদের জানার দরকার যে, বিবাহ বা নিকাহ একটি ইবাদত। এই এবাদত ইখলাসের সাথে আন্তরিকতার সাথে পুত-পবিত্র মনে করা দরকার বিবাহের‘তালাক গ্রহণের চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত হওয়া এটা কোন দ্বীন মুসলিম পরিবারের কাজ হতে পারে না।

স্বামীকে তালাক/ ডিভোর্স দিলাম বলা বা লেখা :

উক্ত ধারা অনুযায়ী স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে স্ত্রী যখন ‘তালাক গ্রহণ করলাম’ না বলে যদি বিষয়টি এভাবে  বলে বা লিখে যে,  ‘আমি আমার স্বামী অমুককে তালাক দিলাম’ বা ‘প্রদান করলাম’ বা ‘ডিভোর্স দিলাম’ তাহলে কখনও তালাক হবে না।  এভাবে তালাক দেয়ার পর স্ত্রী যদি অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার করা আরম্ভ করে  তাহলে এটি হবে একটি মারাত্মক ভুল। কেননা সে এখনও আগের স্বামীরই স্ত্রী রয়ে গেছে। এইটাকে বর্তমানে ডিভোর্স বলে চালিয়ে দেয়। বিষয়টা যেহেতু ধর্মীয় তাই ধর্মমতেই এটাকে আমাদের বোঝা দরকার।

বিধায়, স্ত্রী নিজের উপর তালাক গ্রহণের পরিবর্তে স্বামীকে মৌখিক বা লিখিতভাবে তালাক দিলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তা কার্যকর হয় না। বরং তার স্বামীর সাথে তার বিবাহবন্ধন পূর্বের মতোই বহাল থাকে।

ولهذا قال ابن عباس في امرأة جعل زوجها أمرها بيدها في الطلاق الثلاث فقالت : أنت طالق ثلاثاً، خطا الله نواها لو قالت: أنا طالق ثلاثاً لكان كما قالت :

তাবেয়ী মানসূর রহ. বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলেছে, তোমার তালাক গ্রহণের ক্ষমতা তোমার হাতে। একথা শুনে স্ত্রী বলল, আপনি তিন তালাক। এ সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে বৃষ্টি না দিন (অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য সফল না হোক)। যদি সে (ঐভাবে না বলে) বলতো, ‘আমি তিন তালাক’ তাহলে যা বলেছে তাই হতো।’

(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৯/৫৮২; মাবসূতে সারাখসী ৩/৬৪; আল-ইখতিয়ার লিতা‘লীলিল মুখতার ৩/১৩৬; আলবাহরুর রায়েক ৩/৩৪৩; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৩২৫-৩২৬; ফাতাওয়া খানিয়া ১/৩২৪; বাদায়েউস সানায়ে ৩/১৮৭]

আগেই বলা হয়েছে মুসলিম আইনে তালাকের বিষয়ে স্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত। স্ত্রী’কে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হলে তবেই একজন স্ত্রী তার স্বামীর দেয়া তালাক গ্রহণ করতে পারেন। স্ত্রীকে এরূপ ক্ষমতা অর্পনকে “তালাক-ই-তৌফিজ” বলা হয়। আমাদের এটা স্মরণ রাখতে হবে যে,তালাক-ই-তৌফিজ স্ত্রীর একক ক্ষমতা নয়।

তালাক গ্রহণের শর্তসমূহ গদবাধা লিখে দেওয়া :

শর্তহীন বিবাহতে নিকাহ রেজিষ্টারার গদবাধা কথাগুলো আগেই লিখে নেয়, অনেক সময় বিষয়টা স্বামী জানেই না। আর সেই ক্ষমতা বলে স্বামীর অজ্ঞাতসারে ডিভোর্স বা তালাক গ্রহণ করে। এ ধরনে তালাকও গ্রহণ যোগ্য নয়।

১৮ নং ধারাটি নিজেদের মত করে পূরণ করা:

১৮ নং ধারাটি নিজেদের মত করে পূরণ করার অধিকার কারও নেই। দুপক্ষ বসে অনেক চিন্তা ভাবনা করে এটা পুরণ করবে। স্ত্রী কিছু করলে তার অভিভাবকদের সাথে নিয়েই করবে। একটি সংসার ছেলে খেলা নয় যে, সামান্য কারণে হুট করে স্বামীকে তালাকের নোটিশ পাঠিয়ে দেবে। জরীপে দেখা যায়, গ্রামের তুলনায় শহরে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে তালাক গ্রহণ বা ডিভোর্স প্রদানের ঘটনা বেশি ঘটে। এর থেকে বাঁচার উপায় হলো, সঠিকভাবে এ ধারাটি পূরণ করা। এবং এ সংক্রান্ত যেসব ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে তা থেকে বেঁচে থাকা।

তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে স্ত্রীর এখতিয়ারে দেওয়া :

আলোচ্য ধারায় সাধারণত তালাক গ্রহণের ক্ষমতা সম্পূর্ণ রূপে স্ত্রীর এখতিয়ারে দেয়া হয়। তালাক গ্রহণের আগে নিজ অভিভাবকের সাথে পরামর্শ করার কথা বলা হয় না। এটিও ঠিক নয়। কারণ, স্ত্রী একাকী তালাকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তাতে তাড়াহুড়া বা বাড়াবাড়ির প্রবল আশংকা থাকে। তাই তালাক গ্রহণের ক্ষমতাকে অভিভাবকের অনুমতির সাথে শর্তযুক্ত করে দেওয়া বাঞ্চনীয়। কেননা তালাক গ্রহণের আগে স্ত্রী যদি নিজ অভিভাবকের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করে তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে, অভিভাবকদের হস্তক্ষেপে আপোষ মীমাংসায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তালাক গ্রণের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হবে না। এবং এতে পূর্বাপর চিন্ত না করে হুট করে তালাক গ্রহণের পথও বন্ধ হবে।

কুরআন মাজীদে সূরা আহযাবের ‘আয়াতে তাখয়ীর’ (স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদের এখতিয়ার দেয়ার আয়াত) নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.কে ‘দুনিয়ার অর্থ-বিত্ত চাও না আমাকে চাও’ এ প্রস্তাব দেয়ার সময় বলেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তুমি তাড়াহুড়ো করো না। তুমি তোমার আববা-আম্মার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিও।

وفي رواية للبخاري: قالت عائشة فأنزلت آية التخيير فبدأ بي أول امرأة فقال: إني ذاكر لك أمرا ولا عليك أن لا تعجلي حتى تستأمري أبويك ـ قالت قد أعلم أن أبوي لم يكونا يأمراني بفراقك.

[সহীহ বুখারী ও মুসলিম,]

উক্ত হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিজ অভিভাবকের সাথে পরামর্শ করার কথা বলেছেন। এর থেকে প্রাণিত হয়, স্ত্রীদেরকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণের সময় ‘অভিভাবকদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে’ এ শর্তটি জুড়ে দেয়া উচিত। যেন তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা তাড়াহুড়া না করে, ভুল না করে।

ইসলামে নারীর অধিকার স্বীকৃত:

ইসলাম নারীকে যে, স্বাধীনতা দিয়েছে তা অন্য কোন ধর্মে নেই। বিশেষ করে বিবাহের পরে । বিবাহের পরে যদি স্বামী, স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত না করে স্ত্রীকে আটকে রেখে তার উপর জুলুম নির্যাতন করে এমন অবস্থায় বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর বিধান দিয়েছে।

হবু স্বামীর উপর যদি স্ত্রীর ভরসা না থাকে সঙ্গত কারণে যদি তার উপর হবু স্ত্রীর সন্দেহ সৃষ্টি হয় তাহলে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী তালাক গ্রহণের পূর্বানুমতি পায়; যেন প্রয়োজনবোধে স্ত্রী নিজেই তালাক গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং স্ত্রী বা স্ত্রীপক্ষের জন্য নিকাহনামায় পূরণের সময় স্বামী থেকে সেই অধিকার গ্রহণের সুযোগ শরীয়তে রয়েছে।

তবে এই ধারাটি পূরণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের ভুল ও শরীয়ত পরিপন্থী কাজ সংগঠিত হয়ে থাকে। যার ফলে দেখা যায়, বিয়ের পর স্ত্রীরা অহরহ তালাক গ্রহণ করে থাকে।

বিয়ের আগেই কাবিন করে ফেলা :

বিয়ের আগে কাবিন করার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় খারাবী হলো, অনেকে এই কাবিনকেই বিবাহ মনে করে। ফলে মৌখিকভাবে বিয়ের ইজাব-কবুল না করে শুধু কাবিন করার দ্বারাই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে বলে ধরে নেয়। অথচ মৌখিক ইজাব-কবুল ছাড়া শুধু কাবিন করার দ্বারা কখনোই বিবাহ সংঘটিত হয় না। ফলে ছেলেমেয়ের একত্রে থাকাও বৈধ হয় না। এছাড়া অনেকে কাবিনকে বিবাহ মনে না করলেও কাবিন করার পর ছেলেমেয়ের পরস্পর কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাত, একসাথে চলাফেরা ও নির্জনে সময় কাটানো ইত্যাদিকে বৈধ মনে করে। অথচ নিয়মতান্ত্রিক বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার আগে এসবের কোনোটিই বৈধ নয়।

সূত্র:

তাফসীরে ইবনে কাসী

তাফসীরে কুরতুবী

তাফসীরে কাবীর

ফাতহুল বারী

উমদাতুল কারী

আহকামুল কুরআন

বাদায়েউস সানায়ে

কিতাবুল উসূল