ই‘তিকাফের পরিচয়:
ই‘তিকাফের শাব্দিক অর্থ; কোথাও অবস্থান করা, অবিচ্ছেদ্য ভাবে থাকা, একমুখী হওয়া বা কোনো স্থানে নিজেকে আটকে রাখা বা আবদ্ধ হয়ে থাকা।
শরীয়তের মতে ই‘তিকাফ অর্থ: ইবাদতের জন্য মসজিদে অবস্থান করা। যিনি মসজিদে থাকেন এবং ইবাদত করেন তাকে আকিফ ও মু‘তাকিফ বলা হয়।
ই‘তিকাফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
নিজের অন্তরকে পরিস্কার করে পাশবিক শক্তিকে দমন ও দলন করে দেহ ও মনকে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে নেয়া এবং দুনিয়ার আশক্তি কমিয়ে আখিরাতের স্মরণ বৃদ্ধি করা আর এ অর্জনই হচ্ছে মানব জীবনের বড় সফলতা।
মানুষ যখন আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে যেতে চায় তখন সে দ্বিমুখী আক্রমণের শিকার হয়।
এক. মানুষ আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে গেলে শয়তানের আক্রমণের শিকার হয়, তাই একজন মুমিনকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে শয়তানের আক্রমণ থেকে এবং তাকে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, শয়তানের আক্রমণ কতটা মারাত্মক ও ভয়ানক। শয়তানের আক্রমণের চিত্র মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সামনে তাঁর ভাষায় তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হচ্ছে;
ثُمَّ لآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَآئِلِهِمْ وَلاَ تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।(সুরা আরাফ;১৭)
দুই.আর শয়তানের আক্রমণের পরই রয়েছে ‘নফস’ বা প্রবৃত্তি আক্রমণ। প্রবৃত্তির আক্রমণও একটি ভয়ানক আক্রমণ। মানুষ যদি ‘নফসের’ ধোঁকা বুঝতে সক্ষম না হয় বরং নফসের বেড়াজালে আটকে গিয়ে তার কু-বাসনা গা পেতে মেনে নিলে তখন তার শেষ পরিনাম হয় অত্যন্ত ভয়াবহ। নফস মানুষকে কি কাজের নির্দেশনা দেয়; তার বর্ণনা দিয়েছেন মহান আল্লাহ তা‘আলা, ইরশাদ হচ্ছে;
إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ
নিশ্চয় মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ। (সুরা ইউসুফ;৫৩)
দ্বিমুখী আক্রমণ:
শয়তান মানুষের বাইরের শত্রæ আর নফস হচ্ছে মানুষের ভিতরের শত্রæ। এ দুই শত্রæ মিলে মানুষকে ধ্বংশের অতলগহŸরে নিমজ্জিত করে, আল্লাহর রহমত থেকে দূরে নিয়ে যায় এবং আল্লাহর গজবে পতিত করে। নফস ও শয়তান মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা মহান আল্লাহ তা‘লার ভাষায় শুনুন;
لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِّن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللّهِ إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلاَ مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَالٍ
তাঁর পক্ষ থেকে অনুসরণকারী রয়েছে তাদের অগ্রে এবং পশ্চাতে, আল্লাহর নির্দেশে তারা ওদের হেফাযত করে। আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ যখন কোন জাতির উপর বিপদ চান, তখন তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সুরা রা’দ;১১)
যখন মানুষ নফস ও শয়তানের বেড়াজালে আটকে যায় সে সময় তাদের ক্বলব দুর্বল হয়ে যায় এবং ‘রূহ’ আসমানী নূর থেকে দূরে সরে যায় তখন মানুষের জন্য ধ্বংশ অনিবার্য হয়ে যায় এবং সর্বপ্রকার ব্যর্থতা তাকে গ্রাস করে নেয়।
নফস ও শয়তানকে দুর্বল করার কার্যকরী শক্তি:
আসমানী শক্তি ছাড়া মানুষের পাশবিক শক্তিকে দূর্বল করার বিকল্প কোন পথ নেই। আর এ শক্তি অর্জনের জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলা বহুমুখী ব্যবস্থা রেখেছেন।
কিছু শক্তি অর্জন হয় দৈনন্দিন আমলের দ্বারা আবার কিছু অর্জন হয় সাপ্তাহিক আমলের মাধ্যমে আবার কিছু হয় মাসিক আমলের দ্বারা আবার কিছু মাধ্যম মহান আল্লাহ তা‘আলা এমনও রেখেছেন যা বছরে একবার অর্জন হলে সারা বছর মানুষের রূহ থাকে সজীব ও সতেজ।
এই শক্তিশালী নূর অর্জনের কুদরতী ব্যবস্থা করেছেন মহান আল্লাহ তা‘আলা মাহে রমযানের শেষ দশকে।
আমাদের চাওয়া ছাড়াই মহান আল্লাহ তা‘আলা নিজ দয়ায় ও মায়ায় আমাদের জন্য এ ব্যবস্থাটা করেছেন। আল-কুরআন হচ্ছে শক্তিশালী রজ্জু, বিশাল ঐশী নূর যে নূরের মাধ্যমে মানবের অন্তর আলোকিত হলে কুফর,র্শিক ও সর্বপ্রকার গোমরাহী মানব অন্তর থেকে দূরে সরে যায়। যে, নূর পাশবিক শক্তিকে দমন ও দলন করে উপহার দেয় এক সত্যিকারের বিবেক। যে বিবেক তাকে তার রবকে চিনতে শেখায় এবং চিনতে শেখায় ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝের পার্থক্যকে। পরশ পাথরের সাথে কিছুর স্পর্স হলে পরশ পাথর সেই বস্তুকে যেমন স্বর্ণে পরিণত করে দেয়, তেমনি আল-কুরআনের সংস্পর্সে গেলে মানুষ পায় নতুন ঈমান, নতুন শক্তি, নতুন প্রাণ। আর গোমরাহীর ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবতার পূর্ব আকাশে উদিত হয় সুবহে সাদিকের সোনালী আলো।
اتر کر حِرا سے سوئے قوم آیا *اور اک نسخہ کیمیا ساتھ لایا
এ জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলা সারা বছরের মধ্যে এমন একটি রাত রেখেছেন যে রাতের কল্যাণ ও বরকত মানুষকে সারা বছর চলতে সাহায্য করে। তাই এ রাতের কল্যাণ ও বরকত পাবার জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে যাতে করে সারাটি বছর নফসের বিষাক্ত ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং সতেজ, সজীব বিবেক নিয়ে সারা বছর পথ চলতে পারে। এ জন্যই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ দশকে ই‘তিকাফের ব্যাবস্থা রেখেছেন।
প্রথম ২০ দিনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারা যাবে শেষ ১০ দিনে:
রমযানের প্রথম অংশে কোন কারণে যদি পূর্ণ আত্মিক প্রশান্তি, স্থির চিত্ততা, চিন্তা ও হৃদয়ের একাগ্রতা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ও তাঁর রহমতের দুয়ারে পড়ে থাকার সৌভাগ্য অর্জন না হয়, তার জন্য পরম করুনাময় একটি বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা করেছেন। যেন সে অতি সহজেই তার সে অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে।
সারা বছরের রূহের খোরাক অর্জন হয় এই দশ দিনে:
ইমাম কুরতুবী রহ. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, ক্বদরের রাতে সিদরাতুল মুনতাহায় অবস্থানরত ফিরিশতারা যাদের সাথে জিবরাইল আ. আছেন; দুনিয়ায় আসেন এবং তাদের সাথে থাকা পতাকাসমূহের মধ্য থেকে একটি পতাকা স্থাপন করা হয় আমার কবরের উপর, দ্বিতীয়টি স্থাপন করা হয় বায়তুল মুকাদ্দাসের উপর, তৃতীয়টি স্থাপন করা হয় মসজিদে হারামে আর তচুর্থটি স্থাপন করা হয় তুরে-সাইনাতে। অন্য এক হাদীসে এসেছে ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সে রাতে শয়তান বের হতে পারে না এবং কোন প্রকার প্রভাবও কারো উপর খাটাতে পারে না।
শয়তানের প্রভাব মুক্ত একটি সময়ের দরকার ছিল!
এমন একটা সময়ের দরকার ছিলো যাতে শয়তানের কোন প্রভাব মানুষের উপর না খাটে। যাতে করে মানুষ সেই সময়টাতে তার রূহকে মজবুত করে নিতে পারে এবং তার রবের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।
আর মহান আল্লাহ তা‘আলা এমন একটি কুদরতী ব্যবস্থা করেছেন কুরআন নাযিলের রাতে। যাতে করে মানুষ শয়তানের কোন আক্রমণের প্রকার শিকার না হয় এবং অল্প সময়ে হাজার মাসের এবাদত করে নিতে পারে এবং সারা বছরের রূহের খোরাক অর্জন করতে পারে এবং পাশবিক শক্তিকে দুর্বল করতে পারে।
ই‘তিকাফের গুরুত্ব:
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِّلنَّاسِ وَأَمْناً وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে (মাকামে ইবরাহিম) নামাজের জায়গা বানাও এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু- সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সুরা বাকারা;১২৫)
وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
আর যতক্ষণ তোমরা ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে।(সুরা বাকারা;১৮৭)
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষায়:
১. হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশ দিন বরাবর ই‘তিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর ইন্তিকাকের পর তাঁর স্ত্রীগণ ই‘তিকাফের এ পুণ্য ধারা অব্যাহত রেখেছেন (বোখারি, মুসলিম)
২.হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, প্রতি রমযানেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু ওফাত-পূর্ব রমযানে ই‘তিকাফ করেছেন বিশ দিন। (বোখারী)
৩.হযরত আবু সাইদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম দশকে ই‘তিকাফ করলেন। অতঃপর তিনি মধ্যম দশকে একটি তুর্কী তাঁবুতে ই‘তিকাফ করলেন তিনি নিজের শির বের করে বললেন আমি এ রাত (লাইলাতুল কদর) তালাশ করতে প্রথম দশক ই‘তিকাফ করলাম অতঃপর মধ্যম দশকও ই‘তিকাফ করলাম। তারপর স্বপ্নযোগে আমার কাছে কারো (ফিরিশতার) আগমন হলো এবং আমাকে বলা হলো শেষ দশকে এটা(লাইলাতুল কদর) রয়েছে সুতরাং যে আমার সাথে ই‘তিকাফ করতে চায় সে যেন শেষ দশকে ই‘তিকাফ করে।
( মুসলিম)
ই‘তিকাফের উপকারিতা:
১.হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, লাইলাতুল ক্বদরে ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি ইবাদত করবে তার পূর্বের জীবনের সকল পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।( বোখারী মুসলিম)
২. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ই‘তিকাফ করবে আল্লাহ তায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা(খন্দক) পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন; যা হবে আসমান ও জমিনের দূরত্বের থেকেও বেশি । (কানযুল উম্মাল, হাদিসটির সনদ হাসান পর্যায়ের)
৩.যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় ই‘তিকাফ করবেন তার পূর্বের যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায়। (দায়লামী; হাদীসটি যাঈফ)
৪.হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই‘তিকাফকারী সম্পর্কে বলেছে, সে নিজেকে পাপ থেকে মুক্ত রাখে এবং তাঁর জন্য নেকীসমূহ লেখা হয় ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে বাইরে থেকে যাবতীয় নেক কাজ করে। (ইবনে মাজাহ; হাদীসটি যাঈফ)
৫.লাইলাতুল ক্বদর অর্জন করা, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।
মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
আমি একে(আল-কুরআন) নাযিল করেছি শবে-ক্বদরে।
শবে-ক্বদর সমন্ধে আপনি কি জানেন?
শবে-ক্বদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
৬.ই‘তিকাফকারীর জন্য মেহমানদারীর ব্যবস্থা করা হয়।
হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় যতবার মসজিদে যাবে; আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে ততবার মেহমানদারীর ব্যবস্থা করবেন। (বোখারী)
তাহলে যে ব্যক্তি সর্বদা মাসজিদেই থাকবে তার জন্য কেমন মেহমানদারী হতে পারে! একটু ভাবুন।
৭.শুধু আল্লাহর নিভৃত,নির্জনতা অর্জন হয়।
৮.লাইলাতুল ক্বদর পাওয়া যায় নিশ্চিত ভাবে।
৯.রমযানের ক্ষতি পূরণ সম্ভব হয়।
১০.কুরআন তেলাওয়াতের সৌভাগ্য হয়।
১১.ইলম অর্জন করা সহজ হয়।
১২.নফসের মুহাসাবা করা সম্ভব হয়।
১৩.সুহবাতে সালিহিন নসীব হয়।
১৪.মুরাকাবা ও প্রকৃত নির্জনতার শিক্ষা হয়।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. লিখেছেন:
মসজিদে ই‘তিকাফ হচ্ছে আত্মিক প্রশান্তি, হৃদয়ের পবিত্রতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, ফিরিশতাকুলের গুণাবলী অর্জন করা, শবে ক্বদরের সৌভাগ্য ও কল্যান লাভ করাসহ সকল এবাদতের অখÐ সুযোগ লাভের এক সর্বোত্তম উপায়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা)
রমযানের শেষ দশ দিন কিভাবে কাটাবেন:
রমযানের শেষ দশ দিন মুসলমানদের কিভাবে কাটাতে হবে , নিজেকে দিয়েই আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখিয়ে গেছেন ।
১.হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, রমযানের শেষ দশ দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং ঘরের অন্যদেরও জাগিয়ে দিতেন। তখন তাঁর ইবাদতে নিমগ্নতা ছিল দেখার মত। (বোখারী ও মুসলিম)
২.হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, রমযানের শেষ দশ দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবাদতে এত অধিক প্রচেষ্টা-পরিশ্রম করতেন, যে প্রচেষ্টা-পরিশ্রম এতদ্ব্যতীত অন্যদিনে করতেন না।(মুসলিম)
৩.হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, যখন রমযানের শেষ দশক আসত তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবাদতের জন্য লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে ফেলতেন, তিনি সারারাত জেগে ইবাদত করতেন এবং নিজের পরিবার পরিজনকেও জাগাতেন। (বোখারী, মুসলিম)
লাইলাতুল ক্বদর রমযানের কোন অংশে রয়েছে:
১.অধিকাংশ হাদীস দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয়, লাইলাতুল ক্বদর রমযানের শেষ দশ-দিনে এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে শেষ সাত দিনের যে কোন বেজোড় রাতে নিহিত রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.থেকে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কতিপয় সাহাবা স্বপ্নযোগে দেখলেন, লাইলাতুল ক্বদর রমযানের শেষ সাত দিনে রয়েছে। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, দেখা যাচ্ছে তোমাদের স্বপ্ন অধিকাংশই শেষ সাত দিন সম্পর্কে। অতএব,যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদরের সন্ধান পেতে চায় সে রমযানের শেষ সাত দিনের মধ্যেই সন্ধান করুক। (বোখারী মুসলিম)
২.হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ সাত দিন নির্জন ই‘তিকাফে বসে যেতেন এবং বলতেন শেষ দশ দিনে লাইলাতুল ক্বদরের সন্ধান করো। (বোখারী মুসলিম)
৩.হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধান করো। (বোখরী)
সে রাতের দোয়া:
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম হে আল্লাহর রসূল! আপনি বলে দিন যদি আমি জানতে পারি যে, লাইলাতুল ক্বদর কবে হবে, তাতে আমি কি বলব? রসূল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,তুমি বলবে:
اَللّٰہُمَّ اِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ
(আল্লাহুম্মা ইন্নাকা-আফুউ-বুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা‘ফু আন্নী।)
হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা কর।
( তিরমিজী হাদীসটি সহীহ)
ক্বদরের রাতে ফিরিশতা অবতরণের তাৎপর্য:
মানবজাতি সৃষ্টির পূর্বে এ পৃথিবীতে জিন জাতি বসবাস করত। তারা নানা রকম অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে পৃথিবীতে এক অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। পরে আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে তার খলিফা তথা মানব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন। মানব সৃষ্টির ঘটনাটি মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেছেন:
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاء وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لاَ تَعْلَمُونَ
স্মরণ করুন সে দিনের কথা; যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেশতাদিগকে বললেন: আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুণ-কীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না।(সুরা বাকারা;৩০)
এতে ফেরেশতারা তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এ বলে আপত্তি তুললেন যে,
قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاء
আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে?
কিন্তু ব্যাপারটি যখন বিপরীত হয়ে গেল- পৃথিবীতে আসার পর মানুষ বিপর্যয় ও রক্তারক্তি সৃষ্টির পরিবর্তে আল্লাহ হুকুমের অনুগত হয়ে তাঁর ইবাদত ও মহাত্ম্য প্রকাশে নিজেদেরকে নিয়োজিত করল। বিশেষ করে কুরআন নাযিলের রাতকে খোঁজার জন্য তারা সব ছেড়ে, সব সম্পর্ক ত্যাগ করে যখন মসজিদ মূখী হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট ও রাজি হয়ে ফেরেশতাদেরকে বলেন ও আমার ফিরিশতারা দেখ এই মানুষ কেমনে আমার গোলামী করে। যাও তোমরা দুনিয়ার গিয়ে স্বচক্ষে তা অবলোকন কর।
ই‘তিকাফের বৈশিষ্ট্য:
এতেকাফের একটি বৈশিষ্ট্যহলো যতক্ষণ মানুষ এতেকাফ অবস্থায় থাকে তার চলাফেরা, কথাবার্তা, পানাহার, ঘুম, প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। আর এতেকাফ সুন্নত হওয়ার হেকমত হলো এটাই যে, এতেকাফ ছাড়া লাইলাতুল কদরের ফজিলত ও মর্যাদা লাভের নিশ্চিত কোনো পদ্ধতি নেই।
যে ব্যক্তি পবিত্র মাহে রমজানের শেষ ১০দিন ই‘তিকাফ করবেন, তিনি নিশ্চয়ই ‘লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভ করবেনই। আর লাইলাতুল ক্বদরের ইবাদত হাজার মাস তথা তিরাশি বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। সুতরাং যে ব্যক্তি শেষ দশকে এতেকাফ করবে তার প্রতিটি মুহূর্ত যেহেতু ইবাদত হিসেবে গণ্য হচ্ছে ফলে সে লাইলাতুল ক্বদর পেয়ে যাচ্ছেন।
ই‘তিকাফ কারীর দৃষ্টান্ত:
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন: ই‘তিকাফের মাহাত্ম্য হলো, আল্লাহর সাথে রূহ ও আত্মার সম্পর্ক স্থাপন করা। ই‘তিকাফকারীর দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির মতো- যে কারো দরবারে হাজির হয়ে এ কথা বলে যে, আমার দরখাস্ত কবুল না করা পর্যন্ত আমি ফিরবো না।’
সুতরাং বলা যায়, ই‘িতকাফ মহান আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা এবং সান্নিধ্য লাভের সোপান।
নিজেকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে পবিত্র জীবন গঠনের অবারিত সুযোগ রয়েছে ই‘তিকাফে। যাবতীয় পাপকাজ থেকে মুক্ত থেকে মুত্তাকি হিসেবে যে কেউ নিজেকে গড়ে তুলার ব্যতিক্রমধর্মী অনুশীলন হচ্ছে ইতেকাফ।
ই‘তিকাফ শুরু হবে কখন থেকে:
২১-রমযানে রাতের পূর্বে অর্থাৎ বিশ তারিখের দিনের শেষে সূর্যাস্তের পূর্বে প্রবেশ করতে হবে এবং উনত্রিশ বা ত্রিশ রমজান চাঁদ দেখার পরে ই‘তিকাফকারীগণ মসজিদ থেকে বের হবেন।
ই‘তিকাফ সাধারণত তিন প্রকার হয়ে থাকে:
১.মানতের ই‘তিকাফ আদায় করা ওয়াজিব এমন ই‘তিকাফ অবশ্যই পালন করতে হবে।
২.রমযানের শেষ দশ-দিনে (লাইলাতুল ক্বদরের ছাওয়াব অর্জনের জন্য) ই‘তিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া । সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া বলা হয় মসজিদের মহল্লার মধ্যে থেকে কেউ ই‘তিকাফ করলেই সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়।
৩. এ ছাড়া অন্যান্য ই‘তিকাফ হচ্ছে নফল বা মোস্তাহাব।
মাসআলা: নফল ই‘তিকাফের কোনো নির্ধারিত সময় নেই। যে কোনো মাসের যে কোনো দিনের যে কোনো সময় তা করা যায়। আর এই ই‘তিকাফকেই নফল ইতিকাফ বলে।
মাসআলা: নফল ই‘তিকাফের জন্য রোযা শর্ত নয়। নফল ই‘তিকাফের সর্বনিম্ম সময় এক ঘন্টা। রাতে হোক বা দিনে হোক, যে কোন সময় করা যায়।
মাসআলা: ওয়াজিব ই‘তিকাফের জন্য রোযা শর্ত। সুন্নাত ই‘তিকাফের জন্য রোযা শর্ত হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। কেননা তা রমযানের শেষ দশ দিনের মধ্যে রোযাসহ করতে হয়।
মাসআলা: যদি রমজানের শেষ দশ দিনের কোন এক দিনের ই‘তিকাফ ভেঙে যায় তাহলে কেবলমাত্র ঐদিনটির ই‘তিকাফ কাযা করা ওয়াজিব।
কাযা করার নিয়ম: রামযানের রোযা দ্বারাও ছুটে যাওয়া ই‘তিকাফ আদায় করা যায় বা রমযানের পরে একটা রোযা রেখেও তা আদায় করা যায়।
মাসআলা: এক দিনের ই‘তিকাফ কাযা করার জন্য তাকে মাগরিবের আগেই মাসজিদে প্রবেশ করতে হবে এবং শেষ রাতে সাহরী খেয়ে রোযা রাখতে হবে এবং সারা দিন মাসজিদে অবস্থান করতে হবে, মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে তার ই‘তিকাফ শেষ হবে।
ই‘তিকাফের শর্তসমূহ:
১.ই‘তিকাফের নিয়ত করা।
২.যে মসজিদে পাঞ্জেগানা নামাজ হয় এরূপ মসজিদে অবস্থান করা।
৩.বড় নাপাকী থেকে পাক হওয়া।( যে সমস্ত কারণে গুসল ফরজ হয় এমন নাপাকী যেমন, হায়েজ,নেফাস ও জানাবত।)
৪.মুসলমান হওয়া।
৫.বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া।
৬. মানত ও শেষ দশকের ই‘তিকাফের জন্য রোযা রাখা।
শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের বাইরে যাওয়া যাবে না:
শরয়ী প্রয়োজন বলতে বুঝানো হয়েছে,
১.পেশাব-পায়খানার জন্য।
মনে রাখতে হবে এসব প্রয়োজন এমন স্থানে পূরণ করতে হবে যা মসজিদের নিকটে ।
২.ফরজ গুসলের জন্য।
যদি মসজিদে গুসল করা সম্ভব হয়, যেমন মসজিদের ছাদে বা কোথাও যদি এমন জায়গা থাকে যেখানে পানি নিষ্কাশনের সুন্দর ব্যবস্থা আছে তাহলে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করে গুসল করা যাবে।
৩.খানা খাওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায়, যদি খানা নিয়ে আসার কোনো লোক না থাকে। খানা আনার লোক থাকলে মসজিদে খাওয়াই জরুরী।
৪. বাড়ি থেকে যদি মসজিদে খানা পৌঁছানোর মানুষ থাকে তাহলে বাড়িতে যাওয়া জায়েয নেই। কিন্তু যদি এমন লোক না পাওয়া যায় তাহলে খানা আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। তবে খানা মসজিদে এনেই খেতে হবে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, খানা প্রস্তুত হলেই মসজিদ থেকে বের হবে সে জন্য আগে থেকেই বিষয়টা বাড়িতে বলে রাখবে বা মোবাইলে যোগাযোগ করে যাবে। তবে খানার জন্য অল্প সময় অপেক্ষা করলে কোন সমস্যা নেই।
৪. যে মসজিদে ই‘তিকাফ করছে সেখানে জুমার নামাজ না হলে জুমা আদায়ের জন্য বাইরে যাওয়া জায়েয।
৮. যদি বেচা-কেনার কোনো লোক না থাকে এবং বাড়িতে খাবার কিছু না থাকে তাহলে প্রয়োজনমত বেচা-কেনা করা ই‘তিকাফকারীর জন্য জায়েয। তবে পণ্য-সামগ্রী মসজিদে আনা যাবে না।
৯. আযান দেওয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।
১০.যদি মসজিদে টয়লেট না থাকার ফলে সেখানে হাজত সারা সম্ভব না হয় বা কষ্টসাধ্য হয় তাহলে হাজত সারার জন্য স্বীয় বাড়িতে যাওয়া জায়েয আছে। বাড়ি যতই দূরে হোক না কেন। তবে হাজত সারার পর জলদি চলে আসতে হবে। দেরি করা যাবে না।
১১। যদি মসজিদের নিকট কোন আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি থাকে তাহলে হাজত সারার জন্য সেখানে যাওয়া জরুরি নয়। এটা থাকা সত্তে¡ও নিজের বাড়িতে যাওয়া জায়েয। যদিও তার বাড়ি আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি চেয়ে দূরে হয়।
১২.টয়লেটে যদি লোক থাকে তাহলে লোক বের হওয়ার অপেক্ষায় থাকা জায়েয কিন্তু হাজত সারার পর এক মুহুর্তও দেরি করা জায়েয নেই। টয়লেটে যাওয়া আসার সময় রাস্তায় অথবা বাড়িতে কাউকে সালাম দেওয়া বা সালামের জবাব দেওয়া জায়েয তবে দাঁড়িয়ে কথা বার্তা বলা যাবে না।
ই‘তিকাফ অবস্থায় গুসল করা:
ই‘তিকাফ অবস্থায় ফরজ গুসল করতে কোন সমস্য নেই। জুমার দিনের গুসল ও আরামদায়ক গুসলের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে মুফতীয়ানে কেরাম তাদের জন্য গুসলের একটি পদ্ধতি বাতলিয়ে দিয়েছেন তা হচ্ছে; গুসল খানায় আগে থেকে কাউকে দিয়ে পানি ভরে রাখবে, তারপর ইস্তিনজার জন্য বের হবে, ইস্তিনজা শেষ করে অজু করার সময় দ্রæত গায়ে কিছু পানি ঢেলে চলে আসবে। এতে করে ইতিকাফ ভাঙ্গবে না। তবে গুসল করতে গিয়ে দেরি করবে না। লুঙ্গি ইত্যাদি চেপার জন্য সেখানে দেরি করা যাবে না। কারো মাধ্যমে লুঙ্গিটা ধুয়ে নিবে।
মাসআলা: অজু ও ইস্তিনজার জন্য মাসজিদের নিকটতম জায়গা ব্যাবহার করা।
সঙ্গত কারণে ই‘তিকাফ ভেঙ্গে দেওয়া জায়েয আছে:
যেমন ১.জটিল বা কঠিন রোগ হলে চিকিৎসার জন্য বের হতে পারবে। তবে পরবর্তিতে এক দিনের ই‘তিকাফ কাজা করে দিতে হবে।
২. কাউকে পানিতে ডুবে যেতে দেখলে তাকে বাঁচানোর জন্য বা কোথাও আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য ।
৩. বাবা,মা স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি যদি অসুস্থ হয় এবং তাদের চিকিৎসার জন্য সে ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা না থাকে।
৫. যদি কাউকে রাষ্ট্রপক্ষ গ্রেফতার করে বা জোরপূর্বক বের করে দেয়।
৬. যদি জানাযা পড়ানোর কোন লোক না থাকে তবে জানাযার জন্য ই‘তিকাফ ভেঙ্গে দিতে পারবে। উল্লিখিত অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হলে গুনাহ হবে না তবে ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
ই‘তিকাফে যেসব কাজ করা যাবে না:
যে সকল প্রয়োজনের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো ছাড়া যদি ই‘তিকাফকারী মসজিদের সীমানা অতিক্রম করে চাই তা এক মুহুর্তের জন্য হোক না কেন তাহলে ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, মসজিদ থেকে বের হওয়া তখন বলা হবে যখন পা মসজিদ থেকে এমনভাবে বের হবে যাকে পরিভাষায় মসজিদ থেকে বের হওয়া বলে। তাই যদি শুধু মাথা মসজিদ থেকে বের করে দেয় তাহলে এর দ্বারা ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে না।
১.এতেকাফ অবস্থায় যৌনসম্ভোগ করা এবং স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা হলে এতেকাফ নষ্ট হবে।
২.ই‘তিকাফ অবস্থায় কোনো দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরিমী। বাধ্য হয়ে করলে জায়েয হবে।
৩.ই‘তিকাফ অবস্থায় একেবারে চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ তাহরিমী। যিকির-ফিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকা উচিত।
৪. শরয়ী প্রয়োজনে বের হলে প্রয়োজন সারার পর এক মুহুর্ত দেরি করলে ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
৫. পাগল বা বেঁহুশ হয়ে গেলে ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে।।
৬. নারীদের হায়েয-নিফাস শুরু হয়ে গেলেও ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে।।
মহিলাদের ই‘তিকাফ:
মাহিলাদের জন্যও ই‘তিকাফ জায়েয ও বৈধ। মহিলাদের জন্য মসজিদে ই‘তিকাফ পালন করা মাকরুহ তাহরিমি। মহিলারা তাদের নিজ নিজ গৃহে ই‘তিকাফ করবে। তবে ইসলামের প্রথম যুগে মহিলারা যেমন অবাধে মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন, বর্তমান সময়ে ফেতনার আশঙ্কায় তা জায়েয নয়। বরং মহিলারা ঘরে নিজ কক্ষে ই‘তিকাফ করবে।
মাসআলা: যদি ঘরে ইবাদতের জন্য বিশেষ কোনও স্থান না থাকে, তাহলে ই‘তিকাফের জন্য ঘরের কোনে এক একটি জায়গা পর্দা দিয়ে ঘিরে নিবে এবং সেই স্থানে ই‘তিকাফ করবে।
আর যদি আগে থেকেই ঘরে কোন জায়গা- জিকির,তেলাওয়াত ও ইবাদতের জন্য নির্ধারিত থাকে তাহলে সেই স্থানটি ঘিরে সেখানে ই‘তিকাফ করবে।
মাসআলা: উজু-ইস্তিনজার প্রয়োজন ছাড়া ওই ঘর বা কক্ষ থেকে বের হবে না।
মাসআলা: তবে দরকার হলে ওই কক্ষের ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবে এবং কেউ ভেতরে এলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তাও বলতে পারবে।
মাসআলঅ: ই‘তিকাফের কক্ষটি যদি শয়নকক্ষ হয় এবং একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যে কেউ অবস্থান করেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই; এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন, তবে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ ই‘তিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ; এর দ্বারা ই‘তিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
মাসআলা: ই‘তিকাফের সময় ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবে। ইবাদত, পানাহারসহ সব কাজে ওই স্থানেই নিজেকে সব সময় আবদ্ধ রাখবে। অনর্থক ও পার্থিব কথাবার্তা, কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবে।
মাসআলা: নারীরা ঘরের যে স্থান ই‘তিকাফের জন্য নির্দিষ্ট করবে,সে স্থানটি ই‘তিকাফকালীন তার জন্য মসজিদের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। উল্লিখিত প্রয়োজন ছাড়া সেখান থেকে সরে যাওয়া জায়েজ হবে না। সেই স্থানটির নির্দিষ্ট সীমার বাইরে, ঘরের অন্য অংশেও যেতে পারবেন না। নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে গেলে ই‘তিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
ই‘তিকাফ অবস্থার আমল:
১.ই‘তিকাফ অবস্থায় ই‘তিকাফকারী ফরজ ইবাদতের বাইরে কোনো নফল ইবাদত না করলেও ইতিকাফের সওয়াব পাবে। তবে অতিরিক্ত নফল ইবাদত করলে আরও বেশি ফজিলতের অধিকারী হবে। যেমন: কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা, নফল নামাজ পড়া, কাজা নামাজ আদায় করা, দোয়া করা, দরূদ শরীফ পাঠ করা, জিকির আজকার করা, তাসবীহ-তাহলিল পাঠ করা। সালাতুত তাসবীহ পড়া।
২. দ্বীনি কথাবার্তা ও ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা করাও সওয়াবের কাজ। যেমন: কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, তাফসির ইত্যাদি পাঠ করা ও তালিম করা।
৩.চার ইমামগণের মতে নফল ইবাদত করার চেয়ে দ্বীনি ইলম অর্জন করা উত্তম।
৪.ই‘তিকাফ অবস্থায় এমন সব কথা বলা ও কাজ করা বৈধ, যাতে কোনো গুনাহ নেই।
৫.প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা বলতেও নিষেধ নেই; তবে অহেতুক-বেহুদা কথাবার্তা দ্বারা ইবাদতের পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না।
মাসআলা:
টাকা দিয়ে ই‘তিকাফ করানো:
কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায়, রমযানের শেষ দশ দিনে এলাকাবাসী কেউ ই‘তিকাফ না করে অন্য এলাকা থেকে কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে খানা ও পারিশ্রমিক দিয়ে ই‘তিকাফ করান। এমনটি করা ঠিক নয় কারণ রমযান মাসের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করা সুন্নতে মুআাক্কাদা আলাল কিফায়াহ। যদি কোনো মসজিদে এক জনও ইতেকাফে বসে তাহলে এলাকাবাসী সুন্নত তরকের গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। আর যদি একজনও ই‘তিকাফ না করে তাহলে ঐ এলাকার সকলেই গুনাহগার হবে।
এতেকাফ একটি ইবাদত, যা বিনিময় যোগ্য নয়। তাই ই‘তিকাফের জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয নয়। কাউকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ই‘তিকাফ করালে সে ই‘তিকাফ সহীহ হবে না। অতএব এ জাতীয় ই‘তিকাফ দ্বারা এলাকাবাসী দায়িত্বমুক্ত হতে পারবে না।
মাসআলা: ই‘তিকাফ অবস্থায় চুল আঁচড়ানো,মাথা মুড়ানো, দাড়িতে চিরুনি করা, মাথা, দাঁড়ি, চুলে তেল লাগানো, নখ কাটা, শরীর থেকে ময়লা পরিষ্কার করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, উত্তম পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করা, মসজিদের ভিতরে পানাহার করা এবং ঘুমানোও জায়েয।
মাসআলা: ই‘তিকাফ অবস্থায় বিবাহ পড়ানো যাবে।
মাসআলা: পার্থিব ব্যাপারে কথাবার্তা বলা, অনর্থক গল্পগুজব ও আলোচনা থেকে বিরত থাকা উচিত, তবে পারিবারিক কল্যাণার্থে বৈধ। কোন বিষয়ে অল্পস্বল্প কথাবার্তা বলার মধ্যে কোন দোষ নেই।
রমযানের শেষ দশ দিনে শরয়ী সুন্দর লিবাসে সজ্জিত হওয়া:
ইবনে জারীর রহ. ইবরাহীম নখঈ রহ.সহ বিভিন্ন সালাফ থেকে বর্ণনা করেছেন যে তেনারা রমযানের শেষ দশকে ইশার নমাজের আগে গুসল করতেন। শেষ দশকের রাতগুলো অধিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য এমনটি করা মুস্তাহাব। তবে এমন গুসলের জন্য মু‘তাকিফ মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. রমযানের শেষ দশ দিনে গুসল করতেন এবং তাঁর উত্তম লিবাস পরিধান করতেন। কারণ শেষ দশকে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদর আর ক্বদরের রাতে ফিরিশতারা আগমন করেন। আর ফিরিশতারা অধিক পবিত্রতা পছন্দ করেন। তাই বান্দা অধিক পবিত্রতার জন্য গুসল করে সুগন্ধি লাগিয়ে ইবাদতে মগ্ন থাকবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে শেষ দশকের রাতগুলিতে গুসল করা মুস্তাহাব। আবার এটাও আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে, আমাদের বাহ্যিক দিকটা চকচকে ঝকঝকে ও পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন রাখার চেয়ে অন্তর পরিস্কারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। হযরত ইবনে উমার রা. বলতেন; মানুষের বাইরের সৌন্দর্য ওই সময়ই বেশি মানায় যখন তার ভেতরটা তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহ মুখী হয়ে যায়।
পরিশিষ্ট:
১.মসজিদের কোন কিছু ব্যবহার করবে না।
২.ফোন চার্জ দেওয়ার দরকার হলে কমিটিকে বলে নিতে হবে। ভালো হয় চার্জের বদলে কিছু টাকা মসজিদে দিয়ে দেওয়া।
৩.মসজিদে নির্ধারিত খাদেম না থাকলে রাতে ও বাদ ফজর ঘুমানোর সময় মসজিদের দরজা বন্ধ করার জন্য সবাই মিলে একটা তালিকা তৈরী করে নিবে।
৪. সামানা হেফাজত করবে।
৫. মসজিদের আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে।
৬.নিজের জরুরী সামানা সাথে নিয়ে আসবে।
৭.ই‘তিকাফকারী অনুমতি ছাড়া কারও কোনো কিছুতে হাত দেবে না, বা ব্যবহার করবে না।
৮. মসজিদ বা মুসল্লির ক্ষতি হয় এরূপ কাজকর্ম থেকে সর্বদা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে।
হাদীসে মিম্বারের কথা বার বার স্মরণ করুন!
ইবনে হিব্বান রহ. বিশুদ্ধ সনদে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বারের প্রথম সিঁড়িতে পা মোবারক রেখে বললেন, আমিন। অর্থাৎ আল্লাহ তুমি কবুল করো। আবার যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠলেন, বললেন আমিন! আবার তৃতীয় সিঁড়িতে উঠলেন, বললেন, আমিন! খোতবা শেষে নবী করিম (সা.) যখন মিম্বার হতে অবতরণ করেন, তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো ইয়া রসূলাল্লাহ ! আজ মিম্বারে উঠে আপনাকে আমীন! আমীন! আমীন! বলতে শুনলাম, তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- এইমাত্র হযরত জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি যে রমযান পেল অথচ তার গোনাহ মাফ করে নিতে পারল না। আমি বললাম আমিন! দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিবরাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি যার সম্মুখে তার মা-বাবা অথবা উভয়ের একজন বার্ধক্যে পৌঁছেছে অথচ সে তাদের খেদমত করে জান্নাতি হতে পারল না। তদুত্তরে আমি বললাম আমিন!
তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিবরাইল (আ.) বললেন ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যার সামনে আপনার নাম নেওয়া সত্তে¡ও সে আপনার উপর দরূদ পড়ল না। আমি বললাম আমিন!
হে আল্লাহ আমাদেরকে তোমার মনোনীত বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত কর। আমীন!
তথ্য পুঞ্জি
…………
তাফসীরে কুরতুবী,
রূহুল মা‘আনী,
তাফসীরে ইবনে কাসীর,
মেরকাত শরহে মেশকাত,
ফাতহুল বারী,
উমদাতুল কারী,
হেদায়া,
ফাতহুল কাদীর,
রদ্দুল মুহতার,
বাদায়েউস সানায়ে,
মারাকিল ফালাহ,
বাহরুর রায়েক,
ফাতাওয়া মাহমুদিয়া,
কিতাবুল উসূল,
আল-আসল লিল ইমাম শাইবানী রহ.,
আহসানুল ফাতাওয়া,