শুক্রবার ১৪ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি ১৪ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যে সমস্ত সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয়:

১.সোনা। ২. রূপা। ৩. টাকা-পয়সা। ৪.ব্যবসায়িক সম্পদ।

কি পরিমাণ মাল হলে যাকাত দিতে হয়:

কি পরিমাণ মাল হলে যাকাত দিতে হয়, তা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে, আর এই নির্ধারিত পরিমাণকেই ‘নিসাব’ বলে।

নিম্নের সম্পদ অনুপাতে নিসাবের বর্ণনা তুলে ধরা হলো:

১.কারো মালিকানায় যদি সোনা ছাড়া যাকাতের অন্য কোন সস্পদ (নগদ টাকা, রূপা ও ব্যবসায়িক সম্পদ) না থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ৭.৫ ভরি (সাড়ে সাত ভরি/তোলা)= ৮৭.৪৮ গ্রাম বা এর বেশি সোনা থাকতে হবে। এটা হচ্ছে সোনার একক নেসাব।

২.কারো মালিকানায় যদি রূপা ছাড়া যাকাতের অন্য কোন সস্পদ (নগদ টাকা, সোনা ও ব্যবসায়িক সম্পদ) না থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ৫২.৫ ভরি (সাড়ে বায়ান্ন ভরি/তোলা)=৬১২.৩৬ গ্রাম বা এর বেশি রূপা থাকতে হবে। এটা হচ্ছে রূপার একক নেসাব।

৩.কারো মালিকানায় যদি:

১. সোনা এবং রূপা উভয়টিই থাকে।

২. অথবা সোনা, রূপার সাথে ব্যবসায়িক সম্পদ ও নগদ টাকাও থাকে।

৩.অথবা শুধু নগদ টাকা থাকে।

৪.অথবা শুধু ব্যবসায়িক সম্পদ থাকে।

উল্লিখিত চার ধরণের সম্পদ যে ব্যক্তির কাছে থাকবে এমন ব্যক্তির যাকাতের নিসাব হচ্ছে ৫২.৫ ভরি (সাড়ে বায়ান্ন ভরি/তোলা)=৬১২.৩৬ গ্রাম রূপার সমমূল্যের নগদ টাকা।

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তসমূহ:

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তসমূহ হচ্ছে: ১.স্বাধীন হওয়া। ২.মুসলমান হওয়া।৩.বালেগ তথা প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়া।৪.আকেল বা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া।৫.নিসাব গ্রাস করে নেয় এমন পরিমাণ ঋণ থেকে মুক্ত থাকা। ৬. নিসাব  পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া। ৭. সম্পদের উপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া।৮. মাল বর্ধনশীল হওয়া।

৯. উক্ত সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া।

প্রয়োজনীয় সম্পদ দ্বারা কি বুঝায়?

প্রয়োজনীয় সম্পদ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যতটুকু হলে স্বাভাবিক ভাবে  জীবন চলে যায়; এক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রয়োজন ধর্তব্য নয়। যেমন খাদ্য, পরিধানের কাপড়-চোপড়, থাকার ঘর, ঘরের আসবাব পত্র, পেশাজীবী মানুষের জন্য পেশায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এবং যে সম্পদ মানুষ ব্যবহার করে ও তার সেটা প্রয়োজনও আছে। যে সম্পদগুলো একজন ব্যক্তির জীবিকা নির্বাহে কাজে আসে না এবং যেগুলো ছাড়াও সংসার ভালভাবে চলে যায় কিংবা যে সম্পদগুলো তার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয় না, এমনকি সারা বছরেও কখনো প্রয়োজনে আসে না বরং শোপিস হিসেবে অথবা ব্যবসার জন্য রেখেছে।সেগুলো হচ্ছে ব্যক্তির প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ। উল্লেখ্য যে, টেলিভিশন এবং হারাম বিনোদনের অন্যান্য উপকরণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ বলে গণ্য হবে।

সাহেবে নিসাব(নেসাবের মালিক) যাকাত কখন দিবে:

উল্লিখিত নিসাব পরিমাণ সোনা, রূপা অথবা রূপার নিসাবের সমমূল্যের নগদ টাকা, যে ব্যক্তির কাছে থাকবে তাকে সাহেবে নিসাব বা নিসাবের মালিক বলা হবে। এই সাহেবে নিসাবের উপর যাকাত দেওয়া ফরজ করা হয়েছে। তিনি উক্ত সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত হিসাবে আল্লাহর নির্দেশিত পথে অবশ্যই  খরচ করবেন।

মাসআলা:

১.ব্যবসার আসবাবপত্র ও অলংকারাদি যদি রূপার নিসাবের সমমূল্যের নগদ টাকার পরিমাণে হয় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় তাহলে এগুলোর উপরও যাকাত ফরয।

৩.আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত যাকাত ফরয হয় চার ধরণের সম্পদের উপর। ১.সোনা। ২. রূপা। ৩. টাকা পয়সা। ৪. ব্যবসায়িক সম্পদ। অতএব, বাসা-বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি ও গাড়ি ইত্যাদি যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য(অর্থাৎ, বিক্রি করার নিয়তে) ক্রয় করে থাকে তাহলে এর(বর্তমান বিক্রয়) মূল্যের উপর যাকাত ফরয।কারণ এগুলো তখন ব্যবসার পণ্য হিসেবে পরিগণিত হবে। তবে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় না করে থাকলে তাতে যাকাত ফরয নয়, যদিও তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় বা ভাড়ায় প্রদানের জন্য হয়।

৪.অন্যের কাছে পাওনা অর্থের উপরও যাকাত ফরয। ঐ ব্যক্তি ঋণ আদায়ে গড়িমসি করলেও যদি তা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে এরও যাকাত আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে পাওনাদার চাইলে এখনই এর যাকাতা আদায় না করে, টাকা পাওয়ার পর আদায় করতে পারে। সেক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর যাকাতও আদায় করতে হবে। আর কোন ক্ষেত্রে যদি ঋণ না পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে যায়, তাহলে এ টাকার যাকাত আদায় করা লাগবে না।

৫. যাকাতযোগ্য সম্পদের প্রত্যেকটির উপর ভিন্নভিন্নভাবে বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরী নয়। বরং মূল নেসাবের উপর বছর অতিবাহিত হওয়াই যথেষ্টে। তাই (আরবী তারিখ অনুযায়ী) যে দিন বছর পূর্ণ হবে সেদিন নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তির মালিকানায় যত যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকবে সমুদয় সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে। এর আগের দিনও যদি তার মালিকানায় যাকাতাযোগ্য কোন সম্পদ যুক্ত হয়, তবে এরও যাকাত আদায় করতে হবে।

৬.যাকাতযোগ্য সম্পদের মালিক হওয়ার সাথে সাথেই যাকাত আদায় করা ফরয হয়ে যায় না। বরং তখন থেকে এক বছর অতিক্রম হওয়ার পর যদি উপরে উল্লিখিত পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে তখন তাই উপর যাকাত আদায় করা ফরয হয়।

৭.জমা টাকা-পয়সার উপর সর্বাবস্থায় যাকাত ফরয। তা যে উদ্দেশ্যেই জমা রাখা হোক। অতএব, ঘরবাড়ি,নির্মাণ, বিয়ে-শাদি বা এধরণের কোন প্রয়োজনের জন্য টাকা জমা করলেও তা যদি এককভাবে বা অন্য সম্পদের সাথে মিলে নেসাব পরিমাণ  হয়, এবং বছর পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে এরও যাকাত আদায় করতে হবে। মৌলিক প্রয়োজন অর্থাৎ নিয়মিত (মাসিক) খরচের জন্য থেকে যাওয়া টাকার যকাত দেওয়া জরুরী নয়।

সাদাকাতুল-ফতির

রোযাদার যেন তার  রোযাকে বেহুদা ও অশ্লীল কথা বার্তা ও গর্হিত আচরণ থেকে পবিত্র করতে পারেন এবং  ঈদের আনন্দে ধনীদের সাথে গরীব-দুখীরাও যেন শরীক হতে পারে- এ মহান দুইটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সাদাকাতুল-ফিতর ওয়াজীব করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদাকাতুল-ফিতরকে ওয়াজিব করেছেন-রোযাকে বেহুদা ও অশ্লীল কথাবার্তা জনিত অপরাধ থেকে ও গর্হিত আচরণ থেকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে এবং মিসকিনদের খাদ্যের সুব্যবস্থার জন্যে। যে ব্যক্তি  ঈদের নামাজের আগে তা আদায় করবে, তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের পরে তা আদায় করবে, তার জন্য তা একটি সাধারণ দান হিসাবে গণ্য হবে । আবু দাউদ শরীফ ।

সাদাকাতুল-ফিতর ও যাকাত কেবল তাদেরই   আদায়া করতে হবে যারা  নিসাব পরিমাণে মালের মালিক।

যাকাতের নিসাব ও সদাকাতুল-ফিতরের নিসাব একই রকমের, তবে শুধু এতটুকু পার্থক্য যে যাকাতের নিসাবের উপর বছর অতিবাহিত হতে হয়,এবং ব্যবসার মাল হতে হয়; কিন্তু সাদাকাতুল-ফিতর ক্ষেত্রে শুধু নিসাব পরিমাণে থাকলেই তার উপর ফিতরা প্রদান করা ওয়াজিব হয়ে যায়, চাই সে মাল ব্যবসার হোক বা নাহোক এবং তার  উপর বছর অতিবাহিত হোক বা না হোক।

সাদাকাতুল ফিতর কখন ওয়াজিব হয়?

মাসআলাা:

১.প্রত্যেক স্বাধীন মুসলমানের ওপর ফিতরা আদায় কার ওয়াজিব। যার কাছে ঈদের দিন নিত্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকবে, তার ওপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। এক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া শর্ত নয়।

২.আর যার উপর সাদাকাতুল-ফিতর ওয়াজিব, তার মাল অবশ্যই ঋণ মুক্ত হতে হবে, এবং মৌলিক প্রয়োজন ও পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ হতে উদ্বৃত্ত হতে হবে।

৩. এক জন ব্যক্তি নিজের ও নিজের সম্পদহীণ শিশু সন্তানের পক্ষ থেকে সদাকাতুল-ফিতর আদায় করবেন। আর যদি শিশু সন্তান সম্পদশালী হয় তাহলে তার সম্পদ থেকে আদায় করবেন।

৪.নিজ স্ত্রী ও প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পক্ষ হতে আদায় করা জরুরী নয়। (যদিও তারা তার পরিবার ভুক্ত হয়)

৫.প্রয়োজনের তিরিক্ত জায়গা-জমির মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার উপর সদকাতুল-ফিতর ও কুরবানী ওয়াজিব। সুতরাং কোনো ব্যক্তির কাছে যদি এ অতিরিক্ত সম্পদগুলো থাকে এবং তার মূল্য যদি ৫২.৫ তোলা রূপার সমপরিমাণ হয় তাহলে তার উপর কুরবানি ও ফেতরা ওয়াজিব হবে।  আর এ সম্পদগুলো বিক্রি করে যদি হজ্বে যাওয়ার সামর্থ্য হয়ে যায়, তাহলে  তার উপর হজ্বও ফরজ হবে।  একই সাথে এমন ব্যক্তির জন্য যাকাত ও ফেতরা গ্রহণ করা জায়েয হবে না।

৬। রেডিও, টেলিভিশন, জরুরী আসবাব নয়, তাই সেগুলোর দাম নিসাবের মধ্যে গণ্য হবে।কমপিউটার যদি শুধু বিনোদনের জন্যে না হয়ে বরং প্রয়োজনীয় তথ্য জানা ও জীবিকা অর্জনের সহায়ক হয় তবে তার উপর যাকাত ও সদকাতল-ফিতর ওয়াজিব নয়।

৭। কারণ বশত যদি কেউ রমযানে রোযা না রাখে তাহলে তার উপর সদাকাতুল-ফিতর ওয়াজিব।

৮। একজনের ফিতরা একজন গরিব-মিসকিন বা ফকিরকে দেয়া যাবে। আবার কয়েকজন ফকির বা মিসকিনকেও কিছু কিছু করে দেয়া যাবে। এমনিভাবে কয়েক জনের ফিতরা একত্র করে একজন ফকিরকেও দেয়া যাবে।

৯। যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয আছে তাদেরকে ফিতরা দেওয়াও জায়ের। আর যাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই তাদেরকে ফিতরা দেওয়াও জায়েয নেই।

১০.ইমামতি বা আজান দেয়ার কারণে ফিতরা দেয়া বৈধ নয়। হ্যাঁ, যদি সে ফিতরা নেয়ার উপযুক্ত হয়, তাহলে তাকে ফিতরা দেয়া যাবে।

সদকাতুল-ফিতর কি দ্বারা আদায় করবেন।

যে সমস্ত বস্তু দ্বারা সাদাকাতুল-ফিতর আদায় করা যায়:

১.গম (আর্ধ ‘সা’ =  ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম )

২.যব (১সা =  ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

৩.খেজুর  (১সা =৩ কেজি ৩০০ গ্রাম )

৪.কিসমিস (১সা =৩ কেজি ৩০০ গ্রাম)

৫.পনির (১সা =৩ কেজি ৩০০ গ্রাম)

খেজুর, পনির, কিসমিস ও যবের ক্ষেত্রে তাকে এক ‘সা’ অথবা তার মূল্য আদায় করতে হবে। আর গমের ক্ষেত্রে আধা ‘সা’ অথবা তার মূল্য দিলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। যি কেউ মূল্য দান করে দেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তার সাদাকাতুল-ফিতর আদায় হয়ে যাবে।

শরীয়তে সাদাকাতুল-ফিতর বিধিবদ্ধ হওয়ার যে হিকমতের দিকে হাদীস শরীফে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘গরীব-দুখীদের খেদমত করা’। তাই উল্লেখিত বস্তু সমূহের মধ্য থেকে কোনটির মূল্য নির্ধারণ করলে  গরীব-দুখীদের মৌলিক প্রয়োজন অধিক পরিমাণে পূরণ হয় এবং তারা দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যখেয়ে মহান আল্লাহ পাকের শুকর আদায় করতে পারে, সেদিকে   বিত্তশীলদের লক্ষ্য থাকা উচিৎ ।

আধুনিক পরিমাপের আলোকে ‘সা’/ আর্ধ ‘সা’

ক্স১সা = ৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়)।

অর্থাৎ ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশী।

তবে গরীবদের প্রতি লক্ষ্য করে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম দেওয়াই উত্তম।

ক্সআর্ধ ‘সা’ = ১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম (প্রায়)।

আর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশী।

তবে গরীবদের প্রতি লক্ষ্য করে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম দেওয়াই উত্তম।

যে সমস্ত খাদ্যবস্তু দ্বারা সাদাকাতুল-ফিতর আদায় করা যায়।

দ্রষ্টব্য: যে ব্যক্তি যে শহরে অবস্থান করেন, তিনি সে  শহরের বাজার দর অনুযায়ী সাদাকাতুল-ফিতর আদায় করবেন।

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *